এবার কিসিঞ্জারের ইউক্রেন তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার
ছবি: রয়টার্স

হেনরি কিসিঞ্জার আবার আলোচনায়। এবার ইস্যু ইউক্রেন যুদ্ধ।

চলমান এ যুদ্ধে রাশিয়াকে বিব্রতকরভাবে পরাজিত করতে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যখন এককাট্টা, ঠিক তখনই সংকটের ‘সমাধান’ বাতলে দিয়ে তোপে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে কিসঞ্জারকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের নীতিতে প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করতেও দ্বিধা করেননি। এবার তিনি ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। এ যুদ্ধ এখন চার মাসে পড়েছে। যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। এমন প্রেক্ষাপটে ২৩ মে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে কিসিঞ্জার বক্তৃতা করেন। তিনি মত দেন, যুদ্ধ অবসানে ইউক্রেনের উচিত, রাশিয়ার কাছে নিজের ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া।

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিব্রতকর পরাজয় কামনা না করতেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানান কিসিঞ্জার। তেমনটি হলে তা ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার অবনতি ঘটাতে পারে বলে সতর্ক করে দেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে রাশিয়ার গুরুত্বের কথা পশ্চিমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে কিসিঞ্জার বলেন, রাশিয়ার ব্যাপারে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।

যুদ্ধ শেষ করতে একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছাতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ইউক্রেনকে চাপ দেওয়ার জন্য পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানান কিসিঞ্জার। তিনি মত দেন, দুই মাসের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন সমঝোতা আলোচনা শুরু করা দরকার। বিপর্যয় যাতে এমন পর্যায়ে না যায়, যা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

কিসিঞ্জারের এমন পরামর্শের দিন কয়েক আগে ১৯ মে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় বোর্ড ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে একটি মতামত প্রকাশ করে। এতে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনকে বেদনাদায়ক আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ শান্তির লক্ষ্যে ইউক্রেনকে তার নিজ ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে।

নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় বোর্ড লিখেছে, শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের জনগণকেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, তাঁরাই রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে, মরছে ও ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। এ যুদ্ধের শেষ কেমন হবে, সে ব্যাপারে তাঁদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপসের স্বার্থে ইউক্রেনের নেতাদের বেদনাদায়ক আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পশ্চিমা রাজনৈতিক কুলীনদের মধ্যে শুধু কিসিঞ্জার একাই নন, মার্কিন সাংবাদিক ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক ডেভিড ইগনাশিয়াসও ইউক্রেনকে তার কিছু ভূখণ্ড রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি
ছবি: রয়টার্স

ডেভিড ইগনাশিয়াস ওয়াশিংটনের ভেতরকার মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি নিয়মিত দাভোস সম্মেলনে অংশ নেন। তাঁর মতে, ভবিষ্যতে ইউক্রেন আংশিকভাবে বিভক্ত একটি দেশ হতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে ইউক্রেনীয়দের দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিম জার্মানির উদাহরণ বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ইউক্রেনের বিভাজন কিয়েভের পাশাপাশি তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য পন্থা হওয়া উচিত।

ডেভিড ইগনাশিয়াসের ভাষ্যমতে, ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতা নিষ্ঠুর হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে কিয়েভের জন্য উপকারীই হবে।

তবে যে যা-ই বলুন, এখন কিসিঞ্জারের মন্তব্য তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছে। তাঁর মন্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন সমালোচকেরা। তাঁকে উপহাস করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি (কিসিঞ্জার) দূর অতীত থেকে জেগে উঠেছেন।

কিসিঞ্জারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানির মনোভাবের সঙ্গে তুলনা করেন জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, কিসিঞ্জারের ক্যালেন্ডারটি ২০২২ সালের নয়, ১৯৩৮ সালের। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি দাভোসে নয়, সেই সময়ের মিউনিখে শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলছেন।’

ইউক্রেন যুদ্ধ চার মাসে পড়েছে
ছবি: রয়টার্স

জেলেনস্কি নিউইয়র্ক টাইমসেরও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত ১৯৩৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমসও একই রকম কিছু লিখেছিল। এখন আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, এটা ২০২২ সাল।’

ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের প্রতিটি ইঞ্চি থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত কোনো শান্তি আলোচনা হবে না বলে জানিয়েছে দিয়েছেন জেলেনস্কি। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে রাশিয়াকে কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং শান্তিচুক্তির জন্য রাশিয়াকেই ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চল ইউক্রেনের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

কিসিঞ্জারের পরামর্শের সমালোচনা করে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেন, তিনি কিসিঞ্জারকে সম্মান করেন। কিন্তু তিনি বর্তমানে মার্কিন প্রশাসনের কোনো পদে নেই। তাঁর নিজস্ব মত থাকতে পারে। তবে তাঁরা সেই মতের সঙ্গে মোটেই একমত নন।

কিসিঞ্জারের অবস্থানকে লজ্জাজনক বলে নিন্দা করেছেন ইউক্রেনের পার্লামেন্টের সদস্য ইন্না সোভসুন। ইউক্রেনের পার্লামেন্টের আরেক সদস্য ওলেক্সি গনচারেনকো বলেন, ‘আমার মনে হয়, কিসিঞ্জার এখনো ২০ শতকে বসবাস করছেন। আর আমরা একুশ শতকে আছি। আমরা আমাদের ভূখণ্ডের এক ইঞ্চিও ছাড়ছি না।’

গনচারেনকো মনে করেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম উপায় হলো, ইউক্রেনকে যত দ্রুত সম্ভব ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কিসিঞ্জারের সমালোচনায় তাঁর দেশের সাবেক কূটনীতিকও সরব। কিয়েভে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভেন পিফার এক টুইটে বলেন, ইউক্রেনের ভূখণ্ড কিসিঞ্জারের নয় যে তাঁর কথামতো তা রাশিয়াকে দিয়ে দিতে হবে।

ইউক্রেনে রাশিয়াকে অপমানজনকভাবে হারাতে কিয়েভকে অস্ত্র-অর্থসহ নানা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যান্য পশ্চিমা দেশও ইউক্রেনকে সহায়তা দিচ্ছে। রুশ বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে বলে কিয়েভ আত্মবিশ্বাসী। এমন অবস্থায় কিসিঞ্জারের ‘শান্তির বিনিময়ে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার’ তত্ত্ব নিয়ে সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ইউক্রেনের জনগণও এভাবে ভূখণ্ড ছাড়ের ব্যাপারে সম্মত নয়।

চলতি মাসে কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশিওলজির পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৮২ শতাংশ ইউক্রেনীয় তাঁদের দেশের কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নন, এমনকি তার জন্য যুদ্ধ প্রলম্বিত হলেও নয়।

ইউক্রেনের সরকার ও জনগণ মনে করে, রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার ধারণাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, যুদ্ধবিরতি বা শান্তিচুক্তির বিনিময়ে রাশিয়াকে যদি ইউক্রেন তার ভূমি ছেড়ে দেয়, তাহলে তা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে ভূখণ্ড দখলের ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

রুশ বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে বলে কিয়েভ আত্মবিশ্বাসী
ছবি: রয়টার্স

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ডিফেন্স প্রায়োরিটিসের ফেলো ড্যানিয়েল আর ডিপেট্রিস সম্প্রতি নিউজউইকে এক কলামে লিখেছেন, কিসিঞ্জার আধুনিক যুগের অন্যতম বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। দাভোসে ইউক্রেন ইস্যুতে যে বক্তব্য তিনি রেখেছেন, তার মাধ্যমে ৯৯ বছরে পা রাখা কিসিঞ্জার নিজেকে আরও বেশি বিতর্কিত করেছেন।

ড্যানিয়েল আর ডিপেট্রিসের মতে, ইউক্রেনকে কী করতে হবে, তা কিসিঞ্জারসহ কারোই বলা উচিত নয়। সমঝোতামূলক কোনো পদক্ষেপ দেশ রক্ষার সর্বোত্তম উপায় কি না, তেমনটা হলে তার শর্ত কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের নীতিনির্ধারকেরা নেবেন।

কিসিঞ্জারের বক্তব্যকে অবশ্য ভিন্নভাবে দেখেন শীতলযুদ্ধ-বিষয়ক ইতিহাসবিদ সের্গেই রাদচেনকো। তিনি সম্প্রতি এক পডকাস্টে বলেন, কিসিঞ্জারের কথাকে (ভূখণ্ডের বিনিময়ে শান্তি) যেভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, তা ঠিক বলে তিনি মনে করেন না।

জনস হপকিনস স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক সের্গেই রাদচেনকো মনে করেন, ব্যাপক অভিজ্ঞতার আলোকে কিসিঞ্জার আসলে কূটনীতিক সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন। কেননা, সবাই জানেন, কোনো না কোনোভাবে আলোচনার মাধ্যমেই এ সংকটের সমাধান আসবে।

তথ্যসূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনবিসি, নিউজউইক, বিজনেস ইনসাইডার, দ্য টেলিগ্রাফ ও টিআরটি ওয়ার্ল্ড