কিয়েভে সর্বাত্মক হামলার প্রস্তুতি

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দিকে এগোচ্ছে রুশ সেনাবহর। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল সেনাবহরের অগ্রযাত্রার এ ছবি প্রকাশ করে।
ছবি: এএফপি

ইউরোপইউরোপইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেছে রাশিয়ার বিশাল সেনাবহর। রুশ সেনারা কিয়েভে সর্বাত্মক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে সতর্ক করেছেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, রুশ বাহিনী কিয়েভে হামলার জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধসরঞ্জাম জড়ো করা শুরু করেছে। এ বহরে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান রয়েছে। তাদের বেলারুশ থেকে চেরনোবিল হয়ে জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করা হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে কিয়েভসহ চারটি শহর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। অন্য শহরগুলো হলো ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ ও সুমি এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় মারিউপোল। গুরুত্বপূর্ণ এ তিন শহরও ঘিরে রেখেছেন রাশিয়ার সেনারা। শহরগুলো থেকে বেসামরিক নাগরিকদের, প্রধানত রাশিয়া এবং এ যুদ্ধে তাদের মিত্র হিসেবে ভূমিকা রাখা বেলারুশে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাব অনৈতিক আখ্যায়িত করে খারিজ করেছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ইউক্রেনের নাগরিকদের নিরাপদে দেশের ভেতরেই কোথাও নিতে হবে। এর আগে দুই দফায় মারিউপোল থেকে নাগরিকদের সরিয়ে নিতে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হলেও তা ভেস্তে যায়।

এর মধ্যে গতকাল বেলারুশের ইউক্রেন সীমান্তবর্তী গোমেল শহরে তৃতীয় দফা সমঝোতা বৈঠকে বসেছিলেন ইউক্রেন ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা। বৈঠক শেষে ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের সদস্য ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, আলোচনায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। যুদ্ধবিরতি নিয়ে দুই পক্ষের আলোচনা চলবে। অপর দিকে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের সদস্য ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলেছেন, এ বৈঠক থেকে ইতিবাচক কিছু আসবে কি না, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে আগামী বৃহস্পতিবার তুরস্কের আন্তালায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বৈঠকে বসছেন বলে তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। মস্কো ও কিয়েভের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা তুরস্ক সরকার যুদ্ধ বন্ধে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে।

ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে গতকাল যুদ্ধ বন্ধে কয়েকটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো ক্রিমিয়া অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং ন্যাটোর মতো কোনো জোটে যাবে না, এমন ঘোষণা দিয়ে ইউক্রেনের আইন সংশোধন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণের কাজ শেষ করবে এবং এ শর্তগুলো মেনে নিলে সঙ্গে সঙ্গে সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করা হবে।

অবশ্য যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার শর্তের বিষয়ে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য জানা যায়নি।

রাতভর হামলা

রুশ সেনারা রোববার দিবাগত রাতে ইউক্রেনের মধ্য, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলা নিক্ষেপ বাড়িয়েছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ওলেকসি আরেস্তোভিচ বলেছেন, অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্রের ঢেউ শুরু হচ্ছে। কিয়েভের উপকণ্ঠ, উত্তরাঞ্চলীয় চেরনিহিভ, উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ এবং দক্ষিণাঞ্চলের মিকোলেইভ শহরে হামলা হয়েছে।

রুশ সেনাদের হামলায় কিয়েভের উপকণ্ঠের ইরপিন, হোস্তোমেল ও বুচা শহরে বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে জানান ওলেকসি আরেস্তোভিচ। অবিরাম গোলা নিক্ষেপ ও গোলাগুলির মধ্যে ইরপিন শহর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকা চারজন নিহত হয়েছেন। হোস্তোমেল শহরের মেয়র ইউরি ইলিচ প্রাইলিপকো গতকাল বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে খাবার ও ওষুধ বিতরণের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

হোস্তোমেল, বুচা ছাড়াও ওই অঞ্চলের ভোরজেল শহর এখন রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বলে ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা জানিয়েছেন। এসব শহরের অবস্থা গুরুতর বলে জানান তিনি।

বাড়ছে তেল–সোনার দাম

ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত দেওয়ার পর তা নতুন মাত্রা নিয়েছে। গতকাল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ মার্কিন ডলারে ওঠে, যা ছিল গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরে দাম কমে ১২৫ ডলারে দাঁড়ায়। যুদ্ধ শুরুর আগে দাম ছিল ১০০ ডলারের নিচে। যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সোনার বাজারেও। গতকাল আউন্সপ্রতি সোনার দাম ওঠে ২ হাজার ডলারের ওপরে, যা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর সবচেয়ে বেশি।

ক্ষয়ক্ষতি

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এরপর ইউক্রেনে ২৭ শিশুসহ ৪০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ গত বুধবার দুই হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছিল।

রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ১২ দিনে ইউক্রেন থেকে ১৭ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে গেছেন বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা এ শরণার্থী সংকট মারাত্মক আকার নিতে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাষ্যমতে, এ যুদ্ধে ৪০ লাখের মতো মানুষ ইউক্রেন ছাড়তে পারেন।