দেশ নিয়ে হতাশ কেন ফরাসিরা

প্রতীকী ছবি
রয়টার্স

ফ্রান্সের প্রাইম টাইম টক শোগুলোতে যদি এখন চোখ রাখেন, খেয়াল করবেন ঘুরেফিরে আলোচনার বিষয় একটিই। ফ্রান্সের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন, আয় কমছে, ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ফরাসিদের কাছে দেশটির ভাবমূর্তি ধীরে ধীরে যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ফ্রান্সের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা খোলা চিঠিতে জানান, ফ্রান্স গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে না থাকলেও জনগণের মধ্যে বিভক্তি বাড়ছে।

বিভক্তি যেমন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, তেমনি নেতাদের মধ্যেও। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৪ নভেম্বর মধ্য-ডানপন্থী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী বাছাইপর্বের দ্বিতীয় বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিতর্কে পাঁচ প্রার্থিতাপ্রত্যাশী ব্যক্তির মধ্যে ফ্রান্সের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছে। কট্টর ডানপন্থীদের মতে, ফ্রান্স শেষ হয়ে যাচ্ছে।

ফ্রান্সে ব্যাপক পরিসরে এ উদ্বেগ রয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করে যে ফ্রান্সের পতন হচ্ছে। আরেকটি জরিপে ফ্রান্সের মানুষদের বলা হয়েছিল দেশ সম্পর্কে তাঁরা কী ভাবেন, তা এক কথায় বলতে। জরিপে দেখা গেছে, ফরাসি নাগরিকেরা তিনটি শব্দ বেশি উচ্চারণ করেছেন। তা হলো অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও হতাশা।

অবশ্য ফরাসিদের এমন মনোভাবের পেছনে যে কারণ নেই, তা বলা যাবে না। একের পর এক লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। গ্যাস ও পেট্রলের দাম বাড়ছে, সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, কোভিড-১৯–এর নতুন ঢেউ দেখা দিচ্ছে, বিধিনিষেধ আরোপ হচ্ছে। এসব কিছু মিলেই একটি দেশের পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে সমালোচনা

এদিকে আগামী বছরের এপ্রিলে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বিভক্তি দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে, কট্টর ডানপন্থীদের পক্ষে একজন নন, বরং দুজন প্রভাবশালী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাঁরা হলেন ন্যাশনাল র‌্যালির (সাবেক ন্যাশনাল ফ্রন্ট) নেত্রী মেরিন লা পেন এবং রক্ষণশীল চিন্তাধারাসম্পন্ন সাবেক টিভি তারকা এরিক জেমুর। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ ফরাসি নাগরিক বলেছেন, তাঁরা প্রথম দফার নির্বাচনে এই দুই প্রার্থীর যেকোনো একজনকে ভোট দেবেন। ৬০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ওপর একেবারেই আস্থা নেই তাঁদের।

ফ্রান্সে বর্তমানে অস্থিরতা চলছে—কথাটি যেমন প্রচলিত আছে, তেমনি আবার বিরোধী মতও রয়েছে। সেটি হলো ফ্রান্স বেশ ভালো করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে দেশটি। ফ্রান্সে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আবারও বাড়ছে ঠিকই, তবে তা জার্মানির মতো এতটা দ্রুতগতিতে বাড়ছে না।

ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন

জুলাইয়ে কোভিড পাস চালু করেন মাখোঁ। জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় ফ্রান্সে এখন টিকার পূর্ণ ডোজ নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের মতো ফ্রান্সের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গত বছর দেশটির জিডিপি অনেক কম হলেও চলতি বছর জিডিপির হার ৬ শতাংশ বাড়ার আশা করা হচ্ছে। চলতি বছরের তৃতীয়-চতুর্থাংশে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আগের বছরের এ সময়ের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির এই হার জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের তুলনায় বেশি। ফরাসি জিডিপি এখন মহামারির আগের সময়ের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

ফ্রান্সে মহামারি–পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বেকারত্বের হার কমতে দেখা গেছে। দেশটিতে এখন বেকারত্বের হার ৭.৬ শতাংশ। তবে সরকার পরিচালিত মজুরি স্কিমের কারণেই যে এমনটা সম্ভব হয়েছে, তা বলা যাবে না। কারণ, মহামারি পরিস্থিতিতে এই স্কিম গ্রহণকারী শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলে ৮৪ লাখ মানুষ মজুরি স্কিমের আওতায় সুবিধা নিয়েছিল। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সে সংখ্যা কমে ৫ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

বিমা কোম্পানি অ্যালিয়ঁসের প্রধান অর্থনীতিবিদ লুদোভিচ সুবরান বলেন, ‘ফ্রান্সে উৎপাদনের মতো খাতগুলোতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, যা বেশ কিছুদিন ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বলছে, নিয়োগ জটিলতায় পড়ছে তারা। কারণ, বাড়তি বেতন তাঁদের ওপর চাপ তৈরি করছে।

সরকারের ‘মেইড ইন ফ্রান্স’ কৌশলের আওতায় নতুন কারখানা চালু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলীয় ফ্রান্সের কারখানায় ব্যাটারি ও দক্ষিণ-পশ্চিমের কারখানায় ইনসুলেশন প্যানেল তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া সিএসি ৪০ স্টক মার্কেটের সূচক রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে।

ফরাসি নাগরিকেরা কেন বলছেন ফ্রান্স ধসের মুখে?

তাহলে ফরাসি নাগরিকেরা কেন বলছেন ফ্রান্স ধসের মুখে? এ ব্যাপারে খুব বেশি যুক্তিসংগত ব্যাখ্যাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুঁজিবাদবিরোধী চার ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে নেমেছেন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে ফরাসিদের সংশয়ী হওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে। মহামারির মধ্যে চাকরি ও ব্যবসা সচল রাখতে সরকার বিপুল অর্থ খরচ করেছে। ছাঁটাই ও দেউলিয়াত্ব এড়াতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালে জীবন-যাপনের মান বেড়েছে।

২০২১ সালেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ওই নীতিমালার আওতায় এ ধরনের কারখানাগুলো এখনো প্রণোদনা পাচ্ছে। কর্মসংস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে শেয়ারহোল্ডারদের কিছু ক্ষেত্রে অকল্পনীয় মাত্রায় প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ‘ধনীদের প্রেসিডেন্ট’ বলে পাওয়া তকমাটি মুছে ফেলতে এখন পর্যন্ত জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মাখোঁ।

যে কারণে এমন হতাশা

এমনও হতে পারে, সরকারের কাঠামোর কারণেই হতাশা তৈরি হয়েছে। প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ ক্লুদিয়া সুনিক আরেকটি সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সুখের সঙ্গে ফরাসি নাগরিকদের পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশ মানুষ নিজেদের জীবন নিয়ে সুখী। তবে ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, তাদের দেশ অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। ভাববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ফরাসিরা মনে করেন, বাস্তব জগৎ সব সময় হতাশ করে।

ফ্রান্সের একটি কারখানায় কাজ করছেন কর্মীরা
এএফপি ফাইল ছবি

অল্প বয়স থেকে সমালোচনার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা পাওয়া এ মানুষেরা কোনো কিছুর অনুমোদন না দেওয়াতেই আনন্দ পায়। গত বছর প্রথম করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর করা এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৯ শতাংশ ফরাসি মনে করেন, তাদের সরকার ভালোভাবে সংকটের সামাল দিচ্ছে; যেখানে জার্মানিতে ৭৪ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ৬৯ শতাংশ মানুষ একই রকমের চিন্তাধারা পোষণ করে। ক্লুদিয়া সুনিক মনে করেন, সবকিছু নিয়ে সংশয়ী হওয়ার ও হতাশা খুঁজে বেড়ানোর মনোভঙ্গি পোষণ করে ফরাসিরা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেকোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ফ্রান্সে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ উসকে দিয়ে সমস্যা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়াটা একটি রাজনৈতিক চর্চা। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে সফল হন ফ্রাসোয়াঁ মিতেরঁ। বিশৃঙ্খলা নিরসন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে জ্যাক শিরাক দাবি করেছিলেন, সমাজে চিড় ধরেছে এবং তা ফরাসি ঐক্যের জন্য হুমকি। চিড় ধরে যাওয়া ওই সমাজব্যবস্থা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের নির্বাচনী প্রচারে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। অনেক আশাবাদের কথা শুনিয়েছিলেন তিনি। কোভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, সরবরাহব্যবস্থা আটকে যাওয়া, শাস্তিমূলক বিদ্যুৎ বিল নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে মাখোঁর বিরুদ্ধে। মাখোঁ যদি সেগুলো ভুল প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে বিরোধীরা এসব বিষয় ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে প্রচারের সুযোগ পেয়ে যাবেন।

দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে ফাহমিদা আক্তার