বেলারুশের একনায়ক কি টিকবেন?

১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট পদে আছেন আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো
ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাস এখনো দমে যায়নি। এর মধ্যেই ইউরোপের দেশ বেলারুশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে দেশটির লাখ লাখ মানুষ দলে দলে ভিড় জমাচ্ছে বিক্ষোভে। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপের একনায়ক হিসেবে খ্যাত লুকাশেঙ্কো কি টিকে থাকতে পারবেন?

বেলারুশ একেবারেই রাশিয়ার সংলগ্ন। এর ফলে রাশিয়ার ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বেলারুশের ওপর সব সময়ই থাকে। একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল বেলারুশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বেলারুশ স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। হিস্ট্রি টুডে ডটকমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯৪ সাল থেকেই বেলারুশের প্রেসিডেন্ট পদে আছেন আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো। তিনি মূলত বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভালো নীতিগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকেই ক্রমাগতভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন, এমন অভিযোগ আছে লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে। তিনি পেয়েছেন ইউরোপের শেষ একনায়কের তকমা।

লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ জমতে জমতে এবার উত্তাল বিক্ষোভের রূপ নিয়েছে। সবকিছুর মূলে আছে গত আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন। গত ৯ আগস্টের নির্বাচনের পর আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো ঘোষণা করেন, ৮০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু বিরোধীরা এই বিজয় মানতে নারাজ। তাদের দাবি, এই নির্বাচনে সীমাহীন জালিয়াতি হয়েছে। একটি স্বাধীন নির্বাচনী জরিপে দেখা গেছে, লুকাশেঙ্কো আসলে পেয়েছেন ৪০ শতাংশ ভোট। আর তাঁর প্রতিযোগী স্ভেতলানা টিখানোভসকিয়া পেয়েছেন প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট। বিরোধীদের দাবি, পরাজয় মেনে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেলারুশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনবিক্ষোভ দেখছে বিশ্ব।

অবস্থা আরও বেগতিক হচ্ছে বিক্ষোভ দমাতে লুকাশেঙ্কো বলপ্রয়োগের ঘোষণা দেওয়ায়। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট বিক্ষোভকারীদের ‘ইঁদুর’ বলে উপহাস করেছেন। এর মধ্যে আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছেন যে তিনি লুকাশেঙ্কোর পক্ষে। পুতিন বলেছেন, প্রয়োজন হলে সামরিক সহায়তা দিতেও তিনি রাজি আছেন।

প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে দেশটির লাখ লাখ মানুষ দলে দলে ভিড় জমাচ্ছে বিক্ষোভে। সম্প্রতি বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে হওয়া বিক্ষোভের একাংশ
ছবি: রয়টার্স

একটি রুশ নিরাপত্তা বাহিনী প্রস্তুত আছে, প্রয়োজন হলেই ওই বাহিনী স্বাধীন ও সার্বভৌম বেলারুশে হস্তক্ষেপ করবে। ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাশিয়ার দেওয়া কম মূল্যের তেল ও গ্যাসের ওপর বেলারুশ অত্যন্ত নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগিয়েই বেলারুশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রাশিয়া। তাই অন্য দেশে বাহিনী পাঠাতেও পিছপা হচ্ছেন না ভ্লাদিমির পুতিন।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সাধারণত একনায়কেরা যেভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন, লুকাশেঙ্কোও তা-ই করেছেন এত দিন। এখন তিনি চাইছেন বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার মাধ্যমে বিক্ষোভ দমন করতে। লুকাশেঙ্কো চাইছেন যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। কিন্তু সমস্যা হলো, লুকাশেঙ্কোর প্রশাসনের ভেতরেও এখন ফাটল দেখা দিয়েছে। সাধারণত একনায়কদের কথিত সাফল্যের খবর প্রচার করে থাকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো। কিন্তু এবার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের অনেক কর্মীকেও রাস্তায় নামতে দেখা গেছে।

রাশিয়া যতই বেলারুশের প্রেসিডেন্টের সমর্থনে কথা বলছে, পশ্চিমা শক্তিগুলোও ঠিক ততটাই বিপক্ষে বক্তব্য রাখছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলছে, সংস্থাটি বেলারুশের ওপর নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা দিতে প্রস্তুত হয়ে আছে। ভিন্নমত দমনের জন্য আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো যে বলপ্রয়োগের কথা বলেছেন, তার বিরোধিতাও করেছে ইইউ। এক কথায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলো লুকাশেঙ্কোবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। তারা চায়, সব পক্ষের মধ্যে জাতীয় সংলাপ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমেরিকা এ বিষয়ে অনেকটাই চুপ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে তেমন জোরালো কোনো বক্তব্যই দেননি।

লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ জমতে জমতে এবার উত্তাল বিক্ষোভের রূপ নিয়েছে। সবকিছুর মূলে আছে গত আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচন
ছবি: এএফপি

এদিকে বেলারুশের অস্থিরতায় আঞ্চলিক রাজনীতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা ইউরো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, শিগগিরই বেলারুশে নতুন নির্বাচন হওয়া উচিত। ৯ আগস্টের নির্বাচনে যদি সত্যিই বিপুল পরিমাণ ভোট লুকাশেঙ্কো পেয়ে থাকেন, তবে তাঁর নতুন নির্বাচন দিতে ভয় কোথায়?

‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ বলছে, পুরো পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় বিক্ষোভের যে চল শুরু হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে বেলারুশে। ২০১৯ সাল, এমনকি চলতি বছরেও জনবিক্ষোভ দেখা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। হংকং থেকে লেবানন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও বিক্ষোভ দেখা গেছে। ধনী থেকে দরিদ্র, গণতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক—কোনো দেশই বিক্ষোভের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

‘স্লেট ম্যাগাজিন’-এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিরোধীরা শ্রমিক ধর্মঘট ও রাস্তায় বিক্ষোভ করে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে। অন্যদিকে লুকাশেঙ্কো চাইছেন, পুতিনের সাহায্য নিয়ে সোভিয়েত স্টাইলে বিক্ষোভ দমন করতে। এই সংঘাতমূলক অবস্থানে বেলারুশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

বেলারুশের বার্তা সংস্থা বেল্টা জানিয়েছে, দেশের ভেতরে-বাইরে সীমাহীন চাপের মধ্যে থাকলেও লুকাশেঙ্কো নমনীয় হতে চাচ্ছেন না। সম্প্রতি অস্ত্র হাতে ক্যামেরার সামনে মহড়াও দিয়েছেন ২৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এই প্রেসিডেন্ট। দেশের সাংবিধানিক পরিবর্তন নিয়ে তিনি কথা বলতে চাচ্ছেন শুধু শ্রমিক ও ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধী প্রার্থী স্ভেতলানা টিখানোভসকিয়াকে কোনো ছাড় দিতে লুকাশেঙ্কো রাজি নন।

তবে বেলারুশের এই বিক্ষোভকে ‘পশ্চিমাপন্থী’ বলতে নারাজ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’। এই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশে পশ্চিমাপন্থী যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, বেলারুশে তা ঘটেনি। রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার রেষারেষি থেকে এই বিক্ষোভ তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে অস্থিরতা। সুতরাং এর ফলাফলও ভিন্ন হতে পারে।

বেলারুশে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো ও তাঁর বিরোধীরা—দুপক্ষই দিন দিন মরিয়া হয়ে উঠছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘একনায়ক’-কে না সরিয়ে পথ ছাড়বে না বিক্ষোভকারীরা। লুকাশেঙ্কো আদৌ টিকতে পারেন কি না, সময়েই জানা যাবে তা।