রক্ত আর শোকের ছবি

শুক্রবার রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। প্রতিদিনের মতো রাতের খাওয়া শেষ করে সিয়েনে নদীর পাড়ে হাঁটছি। হঠাৎ রাস্তায় জরুরি সংকেত বাজিয়ে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স যেতে দেখলাম। তার কিছুক্ষণ পরই একটা ভিভিআইপি স্কট গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো শহরে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। তক্ষুনি রুমে ফিরে গেলাম। ফেসবুক খুলেই দেখি আমার ফরাসি বন্ধু জন ফিলিপ পেরনোটের মেসেজ: ‘আর ইউ সেফ ইন প্যারিস?’ (তুমি কি ভালো আছো?)। আমার এ ঘরে টিভি নেই, তাই ইন্টারনেটে বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজের লাইভ স্ট্রিমিংয়ে চোখ রাখলাম। দেখতে পেলাম প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জন নিহত ও শতাধিক আহত। রাতেই ঠিক করলাম, ছবি তুলে ঢাকায় অফিসে পাঠাব। সকাল পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১০০ পার হলো।
আকাশে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবি তুলতে। পাতাল রেলস্টেশনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আলো অফিস থেকে পল্লব মোহাইমেনের কল এল ভাইবারে। অফিসের পক্ষ থেকে ছবি ও খবর পাঠানোর নির্দেশ পেলাম তাঁর কাছে।
ট্রেনে করে গেলাম গার দু নর্দ স্টেশনে। সেখান থেকে দেড় মাইল হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। দেখলাম রাস্তায় লোকজন খুব কম। এমনিতেই শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তার ওপর আবার গত রাত থেকে সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। স্টেশন থেকে ম্যাপের ওপর ভরসা করে হন হন করে হাঁটা শুরু করলাম। পথে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুগলের সঙ্গে দেখা হলো। জানা গেল, ছেলেটার নাম জেরাল্ড ও মেয়েটার নাম কারিন। জানতে চাইলাম, রাতের ভয়াবহ ঘটনার ব্যাপারে তাঁদের প্রতিক্রিয়া। তারা বলল, আমরা চিন্তিত কিন্তু ভীত নই।
যাই হোক, জেরাল্ড ও কারিনের কাছে ঘটনাস্থলের দিকনির্দেশনা নিয়ে এগোতে থাকলাম। একসময় দূর থেকে দেখতে পেলাম বাতাক্লঁ কনসার্ট হলের রাস্তায় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারের গাড়ি। পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনী ঘিরে আছেন সাংবাদিকেরা। আমি ঝটপট কিছু ছবি তুললাম। তারপর পরিস্থিতিটা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম সেখানে।
প্লেস অব রিপাবলিক সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল অসংখ্য ফরাসি জড়ো হয়েছেন ফুল দিয়ে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে। আবেগাপ্লুত হয়ে অনেকেই কাঁদছিলেন। ছবি তুললাম। এর মধ্যে অনেক আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক চলে এলেন। দেখা হয়ে গেল পরিচিত মার্কিন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার জন লোয়েনস্টাইনের সঙ্গে। তিনি নেদারল্যান্ডসের ফটো এজেন্সি এনওওআর ইমেজের সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে এ ঘটনার ছবি তোলা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো। আলাপ হলো প্যারিসের এ চরম সংকটময় সময় নিয়েও। দুপুর নাগাদ ছবি তোলা শেষ করে হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলাম।
(সুমন ইউসুফ প্রথম আলোর আলোকচিত্রী। পেশাগত কারণে ফ্রান্সে অবস্থান করছেন)