রাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ কমছে

সমীক্ষা অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা এখন আরও নেতিবাচক হয়েছে।

রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্ল্যাকার্ড হাতে লন্ডনে বিক্ষোভ করেন রাজতন্ত্রবিরোধীরাছবি: রয়টার্স

রাজতন্ত্র সম্পর্কে গত এক দশকে ব্রিটিশদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও খারাপ হয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, রাজা তৃতীয় চার্লস তাঁর রাজ্যাভিষেকের প্রাক্কালে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।

সিএনএনের সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান সাভান্তা। গত ২৪ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ৯৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মধ্যে অনলাইনে এ সমীক্ষা চালানো হয়।

সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্রিটেনের এক-তৃতীয়াংশ (৩৬ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক বলেছেন, ১০ বছর আগে ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা এখন আরও নেতিবাচক হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটে গেছে। যুগটিকে পরিবর্তিত সময়ের মধ্যেও নিজের কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে অনন্য করে রেখেছিলেন রানি।

জরিপে অংশ নেওয়া ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে ২১ শতাংশ বলেছেন, ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ইতিবাচক হয়েছে। তবে ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রতি ১০ জনের অন্তত ৩ জন বলেছেন, রাজপরিবার নিয়ে খবরে কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু ২২ শতাংশ রাজপরিবার নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তবে অর্ধেকের কিছু কম বলেছেন, তাঁদের মতামতের পরিবর্তন হয়নি। অধিকাংশ ব্রিটিশ নাগরিক রাজ্যাভিষেক ঘিরে যেসব অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, তার অন্তত একটিতে অংশগ্রহণ করার কথা বলেন।

রাজার এই অভিষেক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন দেশটিতে কয়েক দশকের জনসংখ্যাগত, ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন ঘটে গেছে।

প্রজন্মগত বিভক্তি

সিএনএনের সমীক্ষা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে রাজ্যাভিষেকের ঘিরে বিভক্ত মত রয়েছে। রাজপরিবার ও এর সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি নিয়ে প্রজন্ম ঘিরে মতামতের ভিন্নতা পাওয়া যায়। প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশদের অর্ধেকের রাজ্যাভিষেক নিয়ে আগ্রহ থাকলেও খুব বেশি আগ্রহের কথা বলেছেন মাত্র এক-পঞ্চমাংশ নাগরিক। ৪০ শতাংশ ব্রিটিশ রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান দেখার কথা বলেছেন। ২৮ শতাংশ ব্রিটিশ রাজ্যাভিষেকের কনসার্টে আগ্রহ দেখিয়েছেন। ১৪ শতাংশ নাগরিক রাস্তায় পার্টিতে অংশ নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে পুরোপুরি রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকার কথা বলেছেন এক-তৃতীয়াংশ ব্রিটিশ নাগরিক। যাঁদের বয়স ৫৫ বছর বা তার বেশি, তাঁদের মধ্যে ১০ শতাংশ এই অনুষ্ঠান ঘিরে আগ্রহের কথা বলেছেন। এর বিপরীতে ৩৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ এবং ৩৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ এ আয়োজন উপভোগ করতে চান।

এর আগে গত জুনে রানির প্লাটিনাম জুবিলির অনুষ্ঠানের আগে সিএনএন যুক্তরাজ্যের তরুণদের মধ্যে এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাঁরা রাজতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য বৈচিত্র্যের অভাবকে দায়ী করেছিলেন।

সিএনএনের সমীক্ষা অনুসারে, গত এক দশকে রাজপরিবারের প্রতি আগ্রহ হারানোর পেছনে এ পরিবার ঘিরে একাধিক ব্যক্তির বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টির কথা উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে বিতর্কে জড়িয়ে রাজপরিবারের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান প্রিন্স অ্যান্ড্রু। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ভার্জিনিয়া জিওফ্রে নামের এক নারী যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ও ডিউক অব ইয়র্ক প্রিন্স অ্যান্ড্রু ২০০১ সালে তাঁকে তিনবার যৌন নির্যাতন করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। পরে মামলাটি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি করেন প্রিন্স অ্যান্ড্রু।

রাজকীয় প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে বর্ণবাদের গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। সাসেক্সের ডাচেস মেগান অভিযোগ করেন, তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং রাজপরিবার থেকে তিনি বর্ণবাদী আচরণ সয়েছেন। ২০২০ সালে প্রিন্স হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগান মার্কেল রাজপরিবারের দায়িত্ব ছেড়ে যান। গত জানুয়ারিতে প্রিন্স হ্যারি তাঁর আত্মজীবনী স্পেয়ার-এ ব্রিটেনের রাজপরিবারের নানা গোপন কথা সামনে আনেন। হ্যারি তাঁর আত্মজীবনী স্পেয়ার-এ নিজের জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে তাঁর বাবা প্রিন্স চার্লস, সৎমা ক্যামিলা ও বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ তুলেছেন।

এসব অভিযোগ ও বিতর্ক রাজপরিবারের প্রতি জনসাধারণের বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এখন ব্রিটিশ রাজপরিবারকে রোল মডেল হিসেবে দেখেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হয় সিএনএনের সমীক্ষায়। এর উত্তরে ৪৪ শতাংশ ব্রিটিশ বলেছেন, মানুষের পছন্দ করার মতো রাজপরিবারে নেতৃত্ব তৈরি ও নির্দেশনা দেওয়া ভালো উৎস তৈরি হয়নি। ৫৫ শতাংশ তরুণ রাজপরিবারকে রোল মডেল মানতে নারাজ। তবে ৪১ শতাংশ একে রোল মডেল মানেন। তবে ১৫ শতাংশ এ বিষয়ে নিশ্চিত নন।

রাজপরিবারের সব সদস্যকেও অবশ্য একইভাবে দেখা হয় না। প্রিন্স উইলিয়াম ও ক্যাথরিনকে ৬২ শতাংশ ব্রিটিশ পছন্দ করেন। প্রিন্স উইলিয়ামকে পছন্দ করেন না ১৪ শতাংশ আর ক্যাথরিনকে পছন্দ করেন না ১৩ শতাংশ। অন্যরা এ বিষয়ে মতামত দেননি। প্রিন্স চার্লসকে ৫০ শতাংশের কিছু কম লোক পছন্দ করেন। তাঁকে পছন্দ করেন না, এমন মত ২৩ শতাংশের। কুইন কনসোর্ট ক্যামিলাকে নিয়ে মত বিভক্ত। তাঁকে পছন্দ করেন ৩৪ শতাংশ, অপছন্দ করেন ৩২ শতাংশ আর মত দেননি ৩১ শতাংশ। প্রিন্স হ্যারি ও মেগানকে অপছন্দ করার লোকই বেশি। প্রিন্স হ্যারিকে পছন্দ করেন না, এমন হার ৫২ শতাংশ আর মেগানকে অপছন্দ করেন ৫৬ শতাংশ।