ইউক্রেনে আটকে থাকা শস্যের চালান কেন বিশ্বের জন্য জরুরি

ওডেসা অঞ্চলে শস্য সংরক্ষণ করছেন শ্রমিকেরা
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

রাশিয়া কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় কয়েক মাস ধরে আটকে আছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শস্য। শস্য রপ্তানি বন্ধ থাকায় বিশ্বের বেশ কিছু দরিদ্র দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে দেখা গেছে। বেড়েছে খাদ্যসংকট। গত শুক্রবার ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে পণ্যবাহী জাহাজে করে শস্য রপ্তানির ব্যাপারে দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তির পর এ নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেনে কী পরিমাণ শস্য রপ্তানির অপেক্ষায় আটকে আছে এবং তা সেখান থেকে বের করা কেন জরুরি, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

ইউক্রেনে কী পরিমাণ শস্য আটকে আছে

ইউক্রেনে ইতিমধ্যে রপ্তানির অপেক্ষায় থাকা দুই কোটি টন শস্য আটকে পড়ে আছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, চলতি বছর ফসলের মৌসুম শেষে আটকে থাকা শস্যের পরিমাণ ৭ কোটি ৫০ লাখ টনে দাঁড়াবে। ইউক্রেন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বে মোট উৎপাদিত সূর্যমুখী তেলের ৪২ শতাংশ এখানে উৎপাদন হয়। এ ছাড়া ইউক্রেনে ১৬ শতাংশ ভুট্টা ও ৯ শতাংশ গম উৎপাদন হয়।

অন্য বছর ইউক্রেন যে পরিমাণ শস্য উৎপাদন করে, তার তুলনায় এ বছর যুদ্ধের কারণে উৎপাদন কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক লরা ওয়েলেসলি বলেন, ইউক্রেনে সাধারণত ৮ কোটি ৬০ লাখ টন শস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। এ বছর ৩০ শতাংশ উৎপাদন কম হতে পারে।

একই সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া থেকেও গমের রপ্তানি কমেছে। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার কৃষি খাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, ইউরোপের বন্দরগুলোতে কৃষিপণ্য বহনকারী রুশ জাহাজগুলোর প্রবেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে ক্রেমলিন বলছে, জাহাজের জন্য বীমা বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়েছে।

প্রতীকী ছবি
ছবি: রয়টার্স

শস্যঘাটতির কারণে অন্য দেশগুলোর ওপর কী প্রভাব পড়ছে

আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলেছে, আফ্রিকা অঞ্চলের মোট গমের চাহিদার ৪০ শতাংশের সরবরাহ আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। তবে যুদ্ধের কারণে আফ্রিকায় তিন কোটি টন খাদ্যঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে মহাদেশটিতে খাদ্যদ্রব্যের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। নাইজেরিয়ায় পাস্তা ও রুটির মতো খাদ্যদ্রব্যগুলোর দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

একইভাবে ইয়েমেন প্রতিবছর ইউক্রেন থেকে ১০ লাখ টনের বেশি গম আমদানি করে থাকলেও এ বছর যুদ্ধের কারণে সরবরাহ কমে যায়। এতে দেশটিতে গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে ময়দার দাম ৪২ শতাংশ ও রুটির দাম ২৫ শতাংশ বাড়তে দেখা গেছে।

ইউক্রেনের গমের আরেক শীর্ষ আমদানিকারক দেশ সিরিয়ায় রুটির দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

গত শুক্রবার রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্য চুক্তিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমছে। তবে চাথাম হাউসের খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক লরা ওয়েলেসলি মনে করেন, ইউক্রেন থেকে প্রচুর পরিমাণে শস্যের চালান না হলে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশেই ঘাটতি দেখা দেবে।

তিনি বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে এসব দেশে রুটির দাম আরও বেড়ে যাবে। এতে বড় ধরনের সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।’

আরও পড়ুন

সামুদ্রিক করিডর ব্যবহার করে পণ্যবাহী জাহাজগুলোর চলাচলের জন্য বিমা কে দেবে

জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গত শুক্রবার শস্য চুক্তি হয়। চুক্তির আওতায় কৃষ্ণসাগরে একটি সামুদ্রিক করিডর খোলার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে।

রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর কৃষ্ণসাগরে প্রবেশকারী জাহাজের বিমা খরচ বেড়েছে।
লন্ডনভিত্তিক বিমা কর্তৃপক্ষ লয়েডস মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষজ্ঞ নিল রবার্টস বলেছেন, চুক্তিটি হওয়ার পর খরচের পরিমাণ কমা উচিত।

তিনি বলেন, ‘এটি (চুক্তি) আমাদের আশাবাদী করেছে যে ইউক্রেনীয় বন্দরগুলো থেকে শস্য খালাস করা যাবে এবং বাণিজ্য আবারও সচল হবে।’

সাগরে নিরাপদ করিডর স্থাপন ছাড়া শস্য কীভাবে রপ্তানি করা যাবে

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন তাদের রপ্তানিকৃত পণ্যের ৯০ শতাংশের বেশি সাগরপথে পাঠাত। যুদ্ধের কারণে বন্দরগুলো অবরুদ্ধ থাকায় স্থলপথে ট্রাক ও ট্রেন ব্যবহার করে যতটা সম্ভব রপ্তানির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

বাল্টিক সাগরের বন্দর এবং রোমানিয়ার কন্সতান্তা বন্দর থেকে যেন ইউক্রেনের শস্যের চালান বের করা যায়, তা নিশ্চিত করতে ‘সংহতি লেন’ স্থাপনের চেষ্টা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কন্সতান্তা যাওয়ার পথে শস্যগুলোকে দানিউব নদী দিয়ে রণতরীতে করে নেওয়া যাবে। কিন্তু একটা বড় সমস্যা হলো ইউক্রেনের রেললাইনগুলো ইউরোপের অন্য দেশের রেললাইনের তুলনায় চওড়া। এর মানে হচ্ছে, সীমান্তে ট্রেনের বগি থেকে শস্য নামিয়ে অন্য ট্রেনে তুলতে হবে।

রপ্তানিকৃত শস্য ইউরোপ পার হয়ে বাল্টিক বন্দরগুলোতে পৌঁছাতে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিচ্ছে।
বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ দ্য ইউক্রেনিয়ান গ্রেইন অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, যুদ্ধ শুরুর পর মাসে বড়জোর ১৫ লাখ টন শস্য রপ্তানি হচ্ছে।

অথচ যুদ্ধের আগে মাসে ৭০ লাখ টন পর্যন্ত শস্য রপ্তানি হতো।