কেন রুশ অভিবাসীর আক্রোশের শিকার হলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট

১৯৩১ সালের ৬ জুন ফ্রান্সের ১৩তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পল দুমার। এর প্রায় এক বছরের মাথায় ১৯৩২ সালের ৬ মে এক রুশ অভিবাসী তাঁকে গুলি করেন। এক দিন পর, অর্থাৎ ১৯৩২ সালের ৭ মে মারা যান তিনি। আজ ৭ মে এ হত্যাকাণ্ডের ৯২ বছর পূর্ণ হলো। কেন ওই রুশ অভিবাসী ফরাসি প্রেসিডেন্টকে হত্যা করলেন, তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল, তাঁর কী শাস্তি হয়েছিল, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সম্পর্কে কী প্রভাব পড়েছিল—এসব নিয়ে আমাদের আজকের এ আয়োজন।

সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট পল দুমারছবি: ফ্রান্সের সরকারি ওয়েবসাইট এলিসি থেকে সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রখ্যাত লেখকদের বই নিয়ে ১৯৩২ সালের মে মাসে ফ্রান্সে একটি বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পল দুমার ৬ মে প্যারিসের সালোমন ডি রথসচাইল্ড হোটেলে আয়োজিত সেই মেলা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। মেলা ঘুরে ঘুরে স্ত্রীর জন্য কয়েকটি বই কেনেন ৭৫ বছর বয়সী দুমার। এরপর মেলায় উপস্থিত থাকা লেখকদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন তিনি।

সেই মেলায় গোপনে এফএন মডেল ১৯১০ পিস্তল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন খুনিও। প্রেসিডেন্ট দুমারকে চোখে চোখে রাখছিলেন। দুমার যখন লেখক ক্লদ ফারেরের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন হঠাৎ তাঁর ডান বগলে এসে একটি গুলি লাগে। আরেকটি গুলি লাগে তাঁর মাথার খুলিতে। গুলিবিদ্ধ প্রেসিডেন্ট মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। লেখক ফারের তখন হামলাকারীকে জাপটে ধরে ধস্তাধস্তি শুরু করেন। এ সময় হামলাকারী তাঁর ওপরও গুলি চালায় এবং তিনিও আহত হন।

প্রেসিডেন্ট দুমারকে পার্শ্ববর্তী বিউজন হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর জ্ঞান ফিরেছিল ঠিকই, তবে ১৪ ঘণ্টা পর ৭ মে সকালে তিনি মারা যান। বগলে বিদ্ধ গুলিতে তাঁর অ্যাক্সিলিয়ারি ধমনি ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। ১২ মে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে দুমারকে সমাহিত করা হয়।

যেভাবে প্রেসিডেন্ট হলেন দুমার

পল দুমারের জন্ম ১৮৫৭ সালের ২২ মার্চ। অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। ১৮৯৫ সালে তিনি লিওন বুর্জোয়ার মন্ত্রিপরিষদের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। তবে জাতীয় আয়কর প্রণয়নের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তাঁকে এক বছর পর তৎকালীন ইন্দোচীনের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ফ্রান্সের দৃষ্টিকোণ থেকে দুমার ছিলেন ইন্দোচীনের সবচেয়ে সক্রিয় গভর্নর। ১৯০২ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি ইন্দোচীনের বিভিন্ন প্রশাসকের ওপর গভর্নর জেনারেলের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছিলেন। তিনি ঔপনিবেশিক অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তিতে স্থাপন করেছিলেন। তবে ফরাসিরা তাঁর এ উদ্যোগে খুশি হলেও তা স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছিল। কারণ, তাঁদের ওপর কঠোর করারোপ করা হয়েছিল।

১৯১২ সালে করসিকা থেকে সিনেট প্রতিনিধি নির্বাচিত হন দুমার। ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত তিনি সিনেটের সভাপতি এবং গুরুত্বপূর্ণ বাজেট কমিশনের চেয়ারপারসন ছিলেন। তিনি ১৯২১ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২২ সালের জানুয়ারি এবং ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি অ্যারিস্টিড ব্রায়ান্ড সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩১ সালে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর এর এক বছরের মাথায় খুন হন তিনি।

কে এই খুনি

দুমারকে গুলি করার পরপরই তাঁর খুনিকে আটক করা হয়। মেলায় উপস্থিত ক্ষুব্ধ লোকজন তাঁর ওপর হামলে পড়েছিলেন। পরে পুলিশ তাঁকে সেখান থেকে দ্রুত সরিয়ে নেয়। তিনি আসলে কে, কেনই–বা তিনি এমন জঘন্য কর্মকাণ্ডে অংশ নিলেন, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।

তদন্তে জানা যায়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট পল দুমারের হত্যাকারীর নাম পাভেল গোরগুলোভ। তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক, লেখক ও কবি। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর তিনি রাশিয়া থেকে ফ্রান্সে চলে গিয়েছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোরগুলোভ তৎকালীন রুশ সশস্ত্র বাহিনী ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান আর্মিতে কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান। রুশ বিপ্লব শুরু হওয়ার পর গোরগুলোভ বলশেভিকবিরোধী বাহিনী হোয়াইট রাশিয়ান আর্মিতে যোগ দেন। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের জয়ের পর তিনি রাশিয়া ছেড়ে চেকোস্লোভাকিয়ায় চলে যান। সেখান থেকে তিনি ফ্রান্সে চলে যান। ১৯৩২ সালের মে মাসে প্যারিসে যান গোরগুলোভ। এরপর ৬ মে দুমারের ওপর গুলি চালান।

জিজ্ঞাসাবাদে গোরগুলোভ নিজেকে একজন রুশ ফ্যাসিবাদী হিসেবে দাবি করেন, যাঁর লক্ষ্য ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক শাসনের অবসান ঘটানো।

এই হত্যাকাণ্ড–সংক্রান্ত আরও কিছু নথিতে গোরগুলোভকে ‘পিজেন্ট অল-রাশিয়া পিপল’স গ্রিন পার্টি’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত গোরগুলোভ এই দলের একমাত্র সদস্য ছিলেন।

গোরগুলোভ দাবি করেছিলেন, দুমারের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই। প্রেসিডেন্ট দুমারকে লক্ষ্যবস্তু করার কারণ হলো, তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি এমন এক দেশের নেতা ছিলেন, যে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বলশেভিকদের বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করে দিয়েছিল।

গোরগুলোভ বলেছিলেন, ‘ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে বলশেভিজমের পক্ষপাতী বলে মনে হয়। তাই আমি প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ফ্রান্সকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য করতে চেয়েছিলাম! আমি এক মহান রুশ দেশপ্রেমিক। এ কাজে আমার কোনো সহযোগী ছিল না।’

বিচারপ্রক্রিয়া

১৯৩২ সালের ২৫ জুলাই গোরগুলোভের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেল মানসিকভাবে অসুস্থ বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। গোরগুলোভের নথিপত্র ঘেঁটে পুলিশও তাঁর মানসিক অসুস্থতার কিছু আলামত পেয়েছিল।

নথিগুলো থেকে জানা যায়, ‘দ্য গ্রিন ব্রাদার্স’-এর উত্থানের মধ্য দিয়ে রাশিয়া থেকে বলশেভিকদের উৎখাতের জন্য গোরগুলোভ বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিলেন।

দুমারকে ছাড়াও জার্মান প্রেসিডেন্ট পল ভন হিন্ডেনবার্গ ও চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট টমাস মাসারিককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন গোরগুলোভ। তাঁর তালিকায় ভ্লাদিমির লেনিনের নামও ছিল। তবে দুমারকে হত্যার আট বছর আগেই লেনিন মারা যান।

আদালত পাভেল গোরগুলোভকে মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবে মেনে নেয়নি। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার পর গোরগুলোভ বলেছিলেন, ‘নিজের জন্য এবং বন্ধুদের জন্য বীরের মৃত্যুবরণ করছি আমি! ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক! রাশিয়া দীর্ঘজীবী হোক! আমরণ আমি তোমাকে ভালোবেসে যাব।’

১৯৩২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্যারিসের লা সান্ত কারাগারে পাভেল গোরগুলোভের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল।

রাশিয়া-ফ্রান্স সম্পর্কে প্রভাব

নিজেকে ‘মহান রুশ নাগরিক’ বলে দাবি করা পাভেল গোরগুলোভকে ফ্রান্সে বসবাসকারী রুশ নাগরিকেরা সমর্থন দেননি। উল্টো ফ্রান্সে বসবাসকারী রুশ অভিবাসীরা তাঁর কর্মকাণ্ডের কঠোর নিন্দা জানিয়েছিলেন।

রুশ প্রবাসীরা আশঙ্কা করছিলেন, এ ঘটনার পরিণাম ভালো হবে না। একজনের কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁদের সবাইকে শাস্তি পেতে হবে। এমন অবস্থায় রুশ অভিবাসীরা ফ্রান্সের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রমাণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। হত্যাকারীর সঙ্গে নিজেদের ভাবনায় মিল নেই, এমন প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। রুশ কমিউনিটির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ফ্রান্স সরকার এবং প্রয়াত প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর প্রতি শোক জানাতে থাকেন। তাঁর জন্য আয়োজিত স্মরণসভায়ও অংশ নেন তাঁরা।

ওই হত্যাকাণ্ডের পর আরও কিছু উদ্ভট ঘটনা ঘটে। প্যারিসের এক ক্যাফের ওয়েটার ও সাবেক কর্মকর্তা সের্গেই দিমিত্রিয়েভ আত্মহত্যা করে বসেন। ফ্রান্সের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। সুইসাইড নোটে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি ফ্রান্সের জন্য প্রাণ দিলাম!’

তবে ফ্রান্সের গণমাধ্যম ও পার্লামেন্টে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া হলেও বড় ধরনের কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।

এমনকি ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনিও ওই কথিত ‘রুশ ফ্যাসিবাদী’র সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা, রাশিয়া বিয়ন্ড, হিস্টোরিক্যাল ফায়ার আর্মস