চুল পরীক্ষা করে জানা গেল, বিখ্যাত সুরকার বিটোফেন কেন বধির ছিলেন

লুডভিগ ফন বিটোফেনের প্রতিকৃতিছবি: রয়টার্স

লুডভিগ ফন বিটোফেন বিখ্যাত জার্মান সুরকার ও পিয়ানোবাদক। এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে মারা গেছেন এই গুণী সংগীতশিল্পী (১৭৭০–১৮২৭)। বধিরতাসহ নানা শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন ছিলেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ এতটা বছর তাঁর অসুস্থতার কারণ ছিল অজানা। এবার বিজ্ঞানীরা সেই কারণসহ বিস্তারিত তথ্য উদ্‌ঘাটন করেছেন। সেটি তাঁরা করেছেন বিটোফেনের চুলের সংরক্ষিত নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে।

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিটোফেন সিসাজনিত বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন। তবে এমন পর্যায়ের নয়, যা তাঁর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। ফোর্বস সাময়িকীর এক নিবন্ধে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়।

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রাণরসায়নবিদ নাদের রিফাইয়ের নেতৃত্বে একদল ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এ গবেষণা করেন। দুই গুচ্ছ চুলের ডিএনএ পরীক্ষায় বিটোফেনের শরীরে বিষের উপস্থিতি বিশ্লেষণ করেন তাঁরা। দেখা যায়, একজন মানুষের দেহে সিসার ঘনত্বের স্বাভাবিক মাত্রার ৬৪ গুণ ছিল শিল্পীর এক গুচ্ছ চুলে। অপর গুচ্ছে তা ছিল ৯৫ গুণ।

বিটোফেনের শরীরে উচ্চ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী—এমন তথ্য সমর্থন করা না গেলেও এটি তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকার পেছনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে।
নাদের রিফাই, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রাণরসায়নবিদ

এ তথ্য থেকে গবেষক দলের ধারণা, বিটোফেনের রক্তে সিসার মাত্রা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক মাত্রার কয়েক গুণ ছিল।

রিফাই এক বিবৃতিতে বলেন, বিটোফেনের শরীরে উচ্চ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী—এমন তথ্য সমর্থন করা না গেলেও এটি তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকার পেছনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে।

বিটোফেনের শরীরে যে মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে, সেটি সাধারণভাবে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ (খাদ্যনালি, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, মলদ্বার, হজমের আনুষঙ্গিক অঙ্গ, পিত্তথলি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত), কিডনির অসুস্থতা ও কম শোনার মতো সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। আর খ্যাতিমান এ শিল্পী আক্রান্ত হন এসব সমস্যাতেই।

বদমেজাজ, স্মৃতি হারানো, বিক্ষিপ্ত ভাব—বিটোফেন সম্পর্কে জানা এসব সমস্যার পেছনেও ছিল উচ্চ মাত্রায় ওই বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি।

গত সোমবার ক্লিনিক্যাল কেমিস্ট্রি সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘লেটার টু দ্য এডিটর’–এ বিজ্ঞানীরা তাঁদের পাওয়া গবেষণা ফলাফল তুলে ধরেছেন।

এ গবেষণা ফলাফল জার্মান এই সুরকার ও পিয়ানোবাদকের প্রতি মানুষের দীর্ঘস্থায়ী মুগ্ধতাকেই আরেকবার সামনে তুলে আনল। সেই সঙ্গে ১৮২৭ সালে ৫৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কেও ব্যাপক জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটাবে। ১৮০২ সালের ৬ অক্টোবর নিজের লেখা একটি চিঠিতে বিটোফেন মৃত্যুর পর তাঁর অসুস্থতার কারণ তুলে ধরা ও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার অনুরোধ জানান।

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিটোফেন সিসাজনিত বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন। তবে এমন পর্যায়ের নয়, যা তাঁর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল।

বিটোফেনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ওই সময় থেকে নানা তত্ত্ব হাজির করছিলেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। তবে সেসব তত্ত্ব থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ উদ্‌ঘাটন করা যায়নি। এমন বেশ কয়েকটি তত্ত্বে তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অসুস্থতা ও লিভার সিরোসিসের কথা উল্লেখ করা হয়।

এদিকে সাম্প্রতিকতম ওই গবেষণায় বিটোফেনের চুলে উচ্চ মাত্রায় আর্সেনিক ও পারদের উপস্থিতিও পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে তাঁর অসুস্থতার পেছনে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিই বেশি দায়ী বলে তাঁরা মনে করেন।

ফন বিটোফেন সিসার বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন—এমন ইঙ্গিত যে এবারই প্রথম পাওয়া গেল, তা নয়।

এর আগে ২০০০ সালে গবেষকেরা বিটোফেনের চুল বলে ধারণা করা নমুনা পরীক্ষা করে তাতে অতিরিক্ত মাত্রায় সিসার উপস্থিতির বিষয় চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন, এ বিষক্রিয়াতেই সম্ভবত তিনি মারা গেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে ওই চুলের নমুনার আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষায় জানা যায়, এগুলো তাঁর চুল নয়, বরং ইহুদি জনগোষ্ঠীর কোনো একজন নারীর।