শত্রুদের এড়িয়ে কী কৌশলে রাজনীতিকে কবজা করেন স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী

স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোফাইল ছবি: রয়টার্স

রবার্ট ফিকো, স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী। দেশটির বর্ষীয়ান একজন রাজনীতিক তিনি। বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও ঘুরে দাঁড়ানোর অদ্ভুত এক দক্ষতা রয়েছে ফিকোর। বিশ্লেষকদের মতে, এই দক্ষতা তাঁকে স্লোভাকিয়ার রাজনীতিতে শীর্ষে নিয়ে গেছে।  

স্লোভাকিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফিকো হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। তাঁকে একাধিকবার গুলি করা হয়েছে। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রথমে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার কথা জানানো হলেও পরে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী টামাস টারাবা বলেন, ফিকোর অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এ ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে আটক করা হয়েছে। তবে তাঁর পরিচয় জানায়নি পুলিশ। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর বলছে, ওই সন্দেহভাজনের বয়স ৭১ বছর। তিনি লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী।

ঘটনাটি ঘটেছে স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার। স্লোভাকিয়ার ছোট্ট শহর হ্যান্ডলোভায় একটি সরকারি বৈঠকে অংশ নিতে গিয়েছিলেন তিনি। বৈঠক থেকে বের হওয়ার পরপরই ফিকোকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলিবিদ্ধ ফিকোকে একটি কালো গাড়িতে তুলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।

তত দিনে স্লোভাকিয়ায় নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। ফিকো বলতে শুরু করেছেন, ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তার পরিকল্পনায় সায় নেই তাঁর। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে এই পরিকল্পনা বাতিল করবেন তিনি। কাজে লাগে এমন প্রচারণা। ২০২৩ সালের নির্বাচনে ভালো ফল করে ফিকোর দল।

এর আগে ২০১৮ সালে সর্বশেষ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন ফিকো। ওই সময় স্লোভাকিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিক জেন কুচিয়াক ও তাঁর বাগ্‌দত্তাকে হত্যার ঘটনায় তুমুল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অচিরেই তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী ফিকোর পদত্যাগ দাবি করেন।

তুমুল বিক্ষোভের জেরে পদত্যাগে বাধ্য হন ফিকো। যদিও অনেকেই বলেন, ফিকোকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য করার পেছনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ কিসকার ভূমিকা ছিল। আর ফিকো পদত্যাগের পরপর ‘রাজনৈতিক শত্রু’ হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট কিসকাকে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না। আমি কোথাও যাচ্ছি না।’ পরে প্রমাণিত হয় যে তিনি ঠিক বলেছিলেন।

ফিকোর আকস্মিক পদত্যাগে হকচকিত হয়ে পড়ে তাঁর দল। দ্রুত নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয়। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন পিটার পেলেগ্রিনি। ধারণা করা হয়েছিল, ফিকো তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে গেছেন। যদিও পিটার পরে নতুন রাজনৈতিক দল গড়েন।

সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, হামলাকারী ৭১ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তাঁর বাড়ি স্লোভাকিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। তবে তিনি কেন ফিকোর ওপর হামলা চালিয়েছেন, সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে। হাঙ্গেরির একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলেছেন, হামলাকারী একসময় রুশপন্থী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

যা হোক, শাপে বর হয়ে আসে করোনা সংকট। প্রাণঘাতী মহামারি মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের জেরে তৎকালীন মধ্য-ডানপন্থী সরকারের বিরোধিতা করে বিক্ষোভের ডাক দেন ফিকো। এতে ব্যাপক জনসমাগম হয়। ফিকোর বিক্ষোভ ক্রমেই অশান্ত হয়ে ওঠে। গ্রেপ্তার হন ফিকো।

এর পরপরই শুরু হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। নতুন করে সংবাদ শিরোনাম হন ফিকো। ওই সময় স্লোভাকিয়া সরকার ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে চেয়েছিল। এই তালিকায় ছিল গোলাবারুদ, ভারী অস্ত্র, এমনকি যুদ্ধবিমান। কিন্তু ফিকো তৎকালীন সরকারের এমন নীতি প্রত্যাখ্যান করেন।

তত দিনে স্লোভাকিয়ায় নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। ফিকো বলতে শুরু করেছেন, ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তার পরিকল্পনায় সায় নেই তাঁর। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে এই পরিকল্পনা বাতিল করবেন তিনি। কাজে লাগে এমন প্রচারণা। ২০২৩ সালের নির্বাচনে ভালো ফল করে ফিকোর দল।

পিটার পেলেগ্রিনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোট সরকার গড়েন ফিকো। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আবারও ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ দুই বছর পার করেছে। এখনো কিয়েভকে অস্ত্রসহায়তার বিষয়ে পশ্চিমা নীতির সমালোচনা করে চলেছেন ফিকো।

ফিকোর মতে, ইউক্রেন সংকটের সামরিক সমাধান করা সম্ভব নয়। আর দেশটিকে অস্ত্রসহায়তা অব্যাহত রাখার অর্থ হলো কবরস্থানগুলোয় আরও ব্যস্ততা বাড়ানো। তাঁর মতে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পশ্চিমারা ভুলভাবে চিহ্নিত করছে।

ফিকোর জোট সরকার স্লোভাকিয়ায় ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকাজে হাত দেয়। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের অংশ হিসেবে গুরুতর অপরাধ ও দুর্নীতির তদন্তের জন্য দুই দশক আগে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ কৌঁসুলির দপ্তরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আরটিভিএসের এখনকার কার্যক্রম আগামী মাসের মধ্যে গুটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে ফিকো সরকার। নতুন পরিচালক, নতুন কর্তৃপক্ষের অধীনে এই সম্প্রচারমাধ্যম নতুনভাবে কাজ শুরু করবে।

তবে স্লোভাকিয়ায় অনেকেই ফিকোর এই সংস্কারের পক্ষে নয়। ফিকোর বিরোধীরা, এমনকি ইউরোপীয় কমিশন ও ইউরোপীয় সম্প্রচার ইউনিয়ন (ইবিইউ) সতর্ক করে বলছে, ফিকোর এমন উদ্যোগ দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে পারে।

ফিকোর এই সংস্কার নিয়ে স্লোভাকিয়ার পার্লামেন্টে বুধবার সকালে তুমুল বিতর্ক চলছিল। এর মধ্যেই ৫৯ বছর বয়সী ফিকোর গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আসে। বিরোধীদের প্রতিবাদ কর্মসূচি দ্রুত বাতিল করা হয়।

সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, হামলাকারী ৭১ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তাঁর বাড়ি স্লোভাকিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। তবে তিনি কেন ফিকোর ওপর হামলা চালিয়েছেন, সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে। হাঙ্গেরির একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলেছেন, হামলাকারী একসময় রুশপন্থী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন ফিকো। এই যাত্রায় তিনি যদি বেঁচে ফেরেন, তাহলে জীবনের এই আঘাত থেকেও তিনি সম্ভবত নতুন শক্তি অর্জন করবেন। নতুনভাবে এগিয়ে যাবেন।

স্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক আবহ ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে, বিশেষ করে গত অক্টোবরে ফিকো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে। জোট সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ দানকো বলেছেন, দেশ ক্রমশ ‘রাজনৈতিক যুদ্ধের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ফিকোর ওপর হামলার ঘটনা দেশটির সামনে নতুন অনিশ্চয়তার জন্ম দিতে পারে।

আরও পড়ুন