১৯৭৮ সালের ৯ মে। ইতালির রাজধানী রোমের কেন্দ্রস্থলে ব্যস্ত সড়কের পাশে পড়ে আছে একটি গাড়ি। ছোট্ট গাড়িটি ঘিরে অচিরেই রহস্য দানা বাঁধে। পুলিশ আসে। গাড়ির পেছনের অংশ থেকে উদ্ধার করা হয় রক্তাক্ত মরদেহ। গুলিবিদ্ধ মরদেহটি দেখে চোখ কাপালে ওঠে সংশ্লিষ্ট সবার। এ তো যেনতেন কেউ নন। এটা যে ইতালির পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী আলদো মোরোর মরদেহ!
এ ঘটনা শুধু ইতালি নয়, পুরো বিশ্বে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। রেড ব্রিগেডস নামে একটি বামপন্থী সন্ত্রাসী দল অপহরণ করেছিল তৎকালীন ইতালির অন্যতম প্রভাবশালী এই ব্যক্তিকে। টানা ৫৫ দিন নিরুদ্দেশ ছিলেন আলদো মোরো। অবশেষে মেলে মরদেহ। কাজেই রাজনীতির আলোচনা থেকে সংবাদপত্রের শিরোনাম—সবখানে তখন মোরো হত্যাকাণ্ডের খবর।
পুরো নাম আলদো রোমিও লুইগি মোরো। রাজনীতির অঙ্গনে আলদো মোরো নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইতালির আপুলিয়া অঞ্চলে তাঁর জন্ম। বাবা রেনাতো মোরো ছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শক। আর মা ফিদা স্টিচ্চি ছিলেন শিক্ষক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ইতালির সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ধরা হয় আলদো মোরোকে। তিনি তৎকালীন ইতালিতে সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে পাঁচ দফায় মোট ছয় বছরের বেশি সময় তিনি সরকার পরিচালনা করেছিলেন। এর আগে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিচারমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন।
আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন আলদো মোরো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বছরে, অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে ইতালির বারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক হন। আইন বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বইও লিখেছিলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আলদো মোরোর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমেই দেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৪৮ সালে ভোটে জিতে ইতালির আইনসভার সদস্য হন আলদো মোরো।
আলদো মোরো ইতালির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক (ডিসি) পার্টির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ১৯৪৩ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দলের মধ্য বামপন্থী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আলদো মোরো। যদিও তিনি তখন একজন মধ্যপন্থী রাজনীতিক হিসেবে সুপরিচিত। দলের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ইতালির সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ধরা হয় আলদো মোরোকে। তিনি তৎকালীন ইতালিতে সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে পাঁচ দফায় সব মিলিয়ে ছয় বছরের বেশি সময় তিনি সরকার পরিচালনা করেছিলেন। এর আগে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিচারমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন।
আলদো মোরো ধৈর্যশীল, দৃঢ় চরিত্রের ও বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। রাজনীতিতে বিচক্ষণতার সঙ্গে আপস ও সংস্কারের কৌশল বেছে নিয়েছিলেন। তাই নিজের জীবন দিয়ে এর ফল ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে।মার্কো বেল্লোচ্চিও, ইতালীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা
সরকারপ্রধান হিসেবে ইতালিতে আর্থসামাজিক সংস্কারকাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছিলেন আলদো মোরো। আধুনিক ইতালির অন্যতম রূপকার ধরা হয় তাঁকে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অচলাবস্থা তাঁকে বেশ ভুগিয়েছে। সংস্কারকাজের কারণে বামপন্থীরা তাঁর ওপর বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। সেই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধকালে বিশ্বরাজনীতির চাপ সামাল দিতে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে ইতালির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন আলদো মোরো। বিশ্লেষকদের মতে, ওই নির্বাচনে তিনি এগিয়ে থাকতেন। আগে থেকেই তাঁকে সম্ভাব্য বিজয়ী বিবেচনা করছিলেন অনেকে। কিন্তু বিধির বিধান না যায় খণ্ডানো, ওই নির্বাচনে আর অংশ নেওয়াই হয়নি তাঁর।
১৯৭৮ সালের ১৬ মার্চ, ইতালির পার্লামেন্টে একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ওই অধিবেশনে যোগ দিতে গাড়িবহর নিয়ে বাসা থেকে বের হন আলদো মোরো। কিছুদূর যেতেই আকস্মিক হামলা হয় তাঁর গাড়িবহরে। মুহুমুর্হ গুলিতে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। আলদো মোরোর বহরের দুটি গাড়ি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত হন পাঁচজন রক্ষী। বেঁচে যান আলদো মোরো। তাঁকে অপহরণ করা হয়।
১৯৭৮ সালের ১৬ মার্চ, ইতালির পার্লামেন্টে একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ওই অধিবেশনে অংশ নিতে গাড়িবহর নিয়ে বাসা থেকে বের হন আলদো মোরো। কিছুদূর যেতেই আকস্মিক হামলা হয় তাঁর গাড়িবহরে। মুহুমুর্হ গুলিতে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। আলদো মোরোর বহরের দুটি গাড়ি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত হন পাঁচজন রক্ষী। বেঁচে যান আলদো মোরো। তবে তাঁকে অপহরণ করা হয়।
রোমের ব্যস্ত সড়কে এমন সশস্ত্র হামলা, পাঁচবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অপহরণ করার ঘটনায় শোরগোল পড়ে যায়। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয় মোরোর অপহরণের ঘটনা। তুমুল সমালোচনার মুখে মরিয়া হয়ে ইতালির পুলিশ ও সেনারা তল্লাশি অভিযানে নামেন। কিন্তু আলদো মোরোর হদিস মেলেনি।
অভিযোগের আঙুল ওঠে বামপন্থী গেরিলা গোষ্ঠী রেড ব্রিগেডসের দিকে।রেড ব্রিগেডস তখন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সত্তরের দশকের শুরুতে ইতালিতে এই গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু। দেশটিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। দশকজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলা, অপহরণ, নাশকতা চালায় রেড ব্রিগেডসের সদস্যরা।
যা–ই হোক, অপহরণের দুই দিন পর ১৮ মার্চ রেড ব্রিগেডস এক বিবৃতিতে জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে হামলার পেছনে তারা জড়িত। মোরো এখন তাদের জিম্মায় আছেন। জনতার আদালতে (পিপলস ট্রাইব্যুনাল) তাঁর বিচার হবে।
এ বিবৃতি যেন আগুনে ঘি ঢালে। আলদো মোরোকে জীবিত ফিরিয়ে আনতে ইতালিজুড়ে রাজপথে নামেন হাজারো মানুষ। বিক্ষোভ ছড়ায় বিভিন্ন শহরে। এতে ভীষণ চাপে পড়ে যায় ইতালির তৎকালীন সরকার। মোরোর মুক্তির জন্য আবেদন জানায় দেশটির ট্রেড ইউনিয়নগুলো। আলদো মোরোর মুক্তির আহ্বান জানান পোপ ষষ্ঠ পল। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন পোপ।
সব মিলিয়ে দেশে-বিদেশে তখন বেশ চাপের মুখে ইতালি সরকার। দিকে দিকে চলছে তল্লাশি। কিন্তু আলদো মোরোকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা কেউ জানে না। এপ্রিলের মাঝামাঝি রেড ব্রিগেডস জানায়, তুরিনে বিচারের মুখোমুখি তাদের ১৩ সদস্যকে মুক্তি দিতে হবে। তবেই আলদো মোরাকে ছেড়ে দেবে তারা।
কিন্তু ইতালি সরকার ছিল অনড়। রেড ব্রিগেডসের এমন প্রস্তাব মানা হয়নি। এমনকি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানায় সরকার। যদিও নানাভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল।
একপর্যায়ে ইতালি সরকার অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে গোপনে আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রেড ব্রিগেডস গোপন আলোচনার প্রস্তাব খারিজ করে দেয়। জানায়, জনতার আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন আলদো মোরো। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
এমন ঘোষণায় নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। নড়েচড়ে বসে ইতালি সরকার। কয়েক শ সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। উদ্ধার হননি আলদো মোরো।
৭ মে আলদো মোরো তাঁর স্ত্রীর কাছে বিদায়ী চিঠি পাঠান। তিনি লেখেন, ‘তাঁরা (অপহরণকারীরা) জানিয়ে দিয়েছে যে শিগগিরই আমাকে হত্যা করা হবে।’
দুই দিন পর, ১৯৭৮ সালের ৯ মে রোমের ব্যস্ত রাস্তার পাশে পড়ে ছিল রেনো ৪ মডেলের একটি গাড়ি। গাড়ির পেছনের অংশ (বুট) থেকে উদ্ধার করা হয় আলদো মোরোর গুলিবিদ্ধ মরদেহ। হত্যা করার পর গাড়িতে করে এনে পাঁচবারের এই প্রধানমন্ত্রীর মরদেহ ফেলে রাখা হয়েছিল, নাকি গাড়িতেই গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, তা আজও রহস্য।
আলদো মোরোর মরদেহসহ গাড়িটি যে জায়গায় পড়ে ছিল, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। জায়গাটি থেকে আলদো মোরোর দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান কার্যালয় মাত্র ৩০০ গজ দূরে। আর ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরের দূরত্ব মাত্র ২০০ গজ।
কিন্তু কেন রেড ব্রিগেডস আলদো মোরোর মতো প্রভাবশালী একজন রাজনীতিককে অপহরণ করল? কেনই–বা তাঁকে হত্যা করা হলো? এমন প্রশ্ন জনমনে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, আলদো মোরো ইতালির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বলি হয়েছেন।
ওই সময় ইতালির রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দুটি দলের একটি আলদো মোরোর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি। অন্যটি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইতালি। ক্ষমতার রাজনীতিতে দল দুটি জোট গড়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের পর প্রথমবারের মতো সরকারে যায় কমিউনিস্ট পার্টি।
এই দুটি রাজনৈতিক দলের জোট গড়ায় আলদো মোরোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে এই জোটের ঘোর বিরোধী ছিল রেড ব্রিগেডস। তাদের মতে, কমিউনিস্ট পার্টি দুর্নীতিগ্রস্ত ও আগ্রাসী ক্ষমতাকাঠামোর অংশ থাকলে তাদের বিপ্লবের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। বরং দলটি সরকারের বাইরে থাকলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রেড ব্রিগেডসের লড়াই করা সহজ হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি নিয়ে এমন মনোভাবের কারণে আলদো মোরোর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল রেড ব্রিগেডস। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে অপহরণ ও হত্যার পেছনে বড় একটি কারণ ছিল ইতালির ক্ষমতাবলয়ের জোট ভেঙে দেওয়া।
আলদো মোরো হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইতালীয় ভাষায় একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক (সিরিজ) রয়েছে। নাম ‘এক্সটেরিওর নাইট’। ২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ধারাবাহিক নির্মাণ করেছেন মার্কো বেল্লোচ্চিও। পরবর্তী সময়ে এটি যুক্তরাজ্যেও সম্প্রচার করা হয়েছে।
৮৩ বছর বয়সী স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মার্কো বেল্লোচ্চিও স্মৃতি হাতড়ে দিনটি সম্পর্কে বলেন, ওই দিন পরিস্থিতি ছিল থমথমে। সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শিশুদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আরেকটি হামলা হতে যাচ্ছে।
আলদো মোরোর হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির ভূমিকা আছে বলে মনে করেন মার্কো বেল্লোচ্চিও। তিনি বলেন, আলদো মোরোকে নিজেকেই বলি দিতে হয়েছিল। ঠিক যেন যিশুর মতো। কেননা দুই পরাশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিল।
বর্ষীয়ান এই চলচ্চিত্র পরিচালকের মতে, আলদো মোরো ধৈর্যশীল, দৃঢ় চরিত্রের ও বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। রাজনীতিতে বিচক্ষণতার সঙ্গে আপস ও সংস্কারের কৌশল বেছে নিয়েছিলেন। তাই নিজের জীবন দিয়ে এর ফল ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ব্রিটানিকা, ওয়াশিংটন পোস্ট