মূল্যস্ফীতিতে মজুরি বৃদ্ধির দাবি
বিক্ষোভ–ধর্মঘটে স্থবির জার্মানি
ইউরোপের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর শিল্পক্ষেত্রে অস্থিরতার সর্বশেষ নজির এটি।
শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বলছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মজুরি বাড়ানোর দাবি করছেন কর্মীরা।
জার্মানিতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মুখে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। গত সোমবারের এই বিক্ষোভ ও ঘর্মঘটে দেশটির বিমান, রেল ও বাস সেবা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ডাকা এ শ্রমিক ধর্মঘটে স্থবির হয়ে পড়ে জার্মানি। কয়েক দশকের মধ্যে দেশটিতে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভের ঘটনা এটি।
সোমবার কর্মসপ্তাহ শুরুর দিনটির সকালে জার্মানিজুড়ে বিমানবন্দর বন্ধ ছিল। বাস ও ট্রেনস্টেশনগুলোয় কর্মী ছিল না। এতে অনেক যাত্রী ও ভ্রমণকারী সমস্যায় পড়েন।
ভেরদি ট্রেড ইউনিয়ন এবং রেলওয়ে ও পরিবহন ইউনিয়ন ইভিজির ডাকা ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভেরদির প্রধান ফ্রাঙ্ক ওয়ারনেক বলেন, যে শ্রমসংগ্রামের কোনো প্রভাব পড়ে না, সেটি দন্তহীন। তিনি স্বীকার করেন, তাঁদের ঘর্মঘটে অনেক যাত্রী সমস্যায় পড়বেন। তবে তিনি এক দিনের কষ্ট করার আহ্বান জানান।
শ্রমিক ধর্মঘটে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানির জীবনযাত্রা গতকাল অচল হয়ে পড়ে। বিমান, রেল ও বাসসেবা বন্ধ হয়ে যায়।
বার্লিনের ট্রেনস্টেশনে অন্য দিনে ব্যাপক ভিড় থাকলেও গতকাল সকালে অনেকটাই জনশুন্য ছিল। দেশটির জাতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেন সেবা বন্ধ রাখে। ফ্রাঙ্কফুর্ট ও মিউনিখ বিমানবন্দরেও ফ্লাইট বাতিল করা হয়।
বার্লিনের ৩১ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি আধা ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করেও বাস পাননি। আঞ্চলিক ট্রেনগুলোও বন্ধ ছিল। তবে তিনি শ্রমিকদের এই ধর্মঘটকে যৌক্তিক মনে করেন। কারণ, অনেক মানুষ উন্নত কর্মপরিবেশের জন্য দাবি জানাচ্ছেন।
অন্যদিকে অবসরে যাওয়া ৭৩ বছর বয়সী গ্লোরিয়া বায়ারওয়ার্ল্ড মনে করেন, ধর্মঘট বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তাঁর মতে, ‘ধর্মঘটকারীরা যা চাইছেন, তা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আমার মত হচ্ছে, তাঁদের যে চাকরি আছে, সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত।’
ধর্মঘটে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি পূরণের জন্য পরিবহনমন্ত্রী ভলকার উইসিং গত রোববার পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আহ্বান জানান। এ ছাড়া আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য রাতে উড়োজাহাজ চলাচল করতে দেওয়া কথা বলেন।
ভেরদি ইউনিয়ন জার্মানির সরকারি খাতের প্রায় ২৫ লাখ কর্মীর পক্ষ হয়ে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে মধ্যস্থতা করছে, এদের মধ্যে সরকারি গণপরিবহন ও বিমানবন্দরগুলোও রয়েছে। আর রেলওয়ে ও পরিবহন ইউনিয়ন ইভিজি বাস কোম্পানিগুলোর প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কর্মীর পক্ষ হয়ে মধ্যস্থতা করছে।
এই দুই ট্রেড ইউনিয়নের এমন বড় ধরনের যৌথ বিক্ষোভের ঘটনা বিরল। খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চ মূল্যের কারণে জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ায় কয়েক মাস ধরে ইউরোপের বড় অর্থনীতিগুলোর শিল্পক্ষেত্রে দেখা দেওয়া অস্থিরতার সর্বশেষ নজির এটি।
চাকরিদাতা বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করে আসছে। এর পরিবর্তে এ বছর ৫ শতাংশ মজুরি বাড়িয়ে দুবারে ১ হাজার ইউরো ও পরের বছর দেড় হাজার ইউরো করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে ভেরদির দাবি, মাসিক বেতন সাড়ে ১০ শতাংশ বাড়ানো হোক। ইভিজির দাবি, ১২ শতাংশ মাসিক বেতন বাড়ানো হোক।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ট্রেন কোম্পানি ডয়চে বানের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মার্টিন সেইলার দেশব্যাপী এই ধর্মঘটকে ভিত্তিহীন ও অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে দ্রুত আলোচনার টেবিলে ফেরার আহ্বান জানান।
জার্মানির এয়ারপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের এই ধর্মঘটে ৩ লাখ ৮০ হাজার বিমানযাত্রীর ওপর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের এই ধর্মঘট কল্পনাযোগ্য ও ন্যায়সঙ্গত পরিমাপের বাইরে চলে গেছে।
নিয়োগকর্তারা শ্রমিক প্রতিনিধিদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে উসকানির অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের ভাষ্য, এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। তবে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বলছে, তাদের সদস্যরা জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মজুরি বাড়ানোর জন্য দাবি করছেন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলা শুরুর পর বিশ্বের অনেক দেশের মতোই জার্মানিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে।
জার্মানি ছাড়াও সম্প্রতি একই ধরনের বিক্ষোভ ও ধর্মঘট হয়েছে যুক্তরাজ্যেও। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মীরা সড়কে নামেন। জার্মানির স্থানীয় গণমাধ্যমে এই ধর্মঘটকে ‘বিশাল ধর্মঘট’ বলে তুলে ধরেছে। গতকাল সোমবার বেতন নির্ধারণ নিয়ে সরকারি খাতের কর্মীদের সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনা হওয়ার কথা।