প্রিগোশিনের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে যেভাবে আঘাত হানছেন পুতিন

রাষ্ট্রীয় একটি নৈশভোজে ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে ইয়েভগেনি প্রিগোশিন (বাঁয়ে)। ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উপকণ্ঠে তোলা
ছবি: রয়টার্স

ভাগনার যোদ্ধারা যখন রাশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন, সে সময় রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) সদস্যরা সেন্ট পিটার্সবার্গে বাহিনীটির প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে সবকিছু তছনছ করেন।

মুখোশধারী ব্যক্তিরা প্রিগোশিনের প্রতিষ্ঠান প্যাট্রিয়ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয় থেকে কম্পিউটার ও নথিপত্র জব্দ করে নিয়ে যায়। এটা প্রিগোশিনের নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।  

বিদ্রোহ–পরবর্তী সময়ে রুশ কর্তৃপক্ষের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সামরিক ঘাঁটির কাজকে ব্যাহত না করেই প্রিগোশিনের সরবরাহ চেইনে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
—ডেনিস কোরোতকভ, ভাগনারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।

প্যাট্রিয়ট গ্রুপের অনলাইন আউটলেট রিয়া ফান-এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওরা (নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য) সদর দরজা ভেঙে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে। মনে হচ্ছিল, এটা দেশপ্রেমিক সাংবাদিকের কর্মস্থল নয়, বরং ওরা অবৈধ কোনো পতিতালয় ধ্বংস করতে এসেছে।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন গত মাসের শেষের দিকে। এ সময় হঠাৎ করে রাশিয়ার সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার। ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বাধীন ভাগনার ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে সহায়তা দিয়ে আসছিল।

আরও পড়ুন

প্যাট্রিয়টের বেশ কয়েকজন সদস্য গত ২৪ জুনের এই ঘটনা ‘গার্ডিয়ান’–এর কাছে বর্ণনা করেছেন। এর আগের দিন অর্থাৎ ২৩ জুন বিদ্রোহ করেছিলেন প্রিগোশিন। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে যে প্রিগোশিনের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দমন করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে ক্রেমলিন। কেননা, প্রেসিডেন্ট পুতিনের ২৩ বছরের শাসনামলকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেন প্রিগোশিন।  

তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রিগোশিন বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় ও জটিল একটি করপোরেট কাঠামো তৈরি করেছেন। শুধু ভাড়াটে সেনা সরবরাহ নয়, একাধারে সংবাদমাধ্যম, খনি, লজিস্টিক, চলচ্চিত্র, ক্যাটারিংসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন তিনি।

প্রিগোশিনের উত্থান


রাশিয়ায় একসময় পুতিনের বাবুর্চি হিসেবে পরিচিত ছিলেন প্রিগোশিন। সেখান থেকে তিনি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পুতিনের আনুকূল্যে এত দিন ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তাঁর এই সাম্রাজ্য। কিন্তু সময় বদলেছে। পুতিনের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে এখন চক্ষুশূল হয়েছেন প্রিগোশিন। তাই তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের লাগাম টানতে রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিদ্রোহের পর পুতিন ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রিগোশিনের করপোরেট সাম্রাজ্যের অর্থের উৎস তদন্ত করে দেখা হবে। সেনাদের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সময় পুতিন বলেছেন, ভাগনারে অর্থায়ন ছাড়াও প্রিগোশিনের ক্যাটারিং কোম্পানি কনকর্ড সামরিক চুক্তির আওতায় ২০২২ সালের মে থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি ডলার পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘কেউ চুরি করেনি বা বেশি চুরি করেনি। তবে আমরা এটা খতিয়ে দেখব।’

ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন
ফাইল ছবি: এএফপি

রাশিয়ায় এর আগেও অনেক বিরোধী সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার শুরুতে প্রিগোশিনের সংবাদমাধ্যমের ওপর খড়্গ নামানো হয়েছে। গত মাসের শেষ দিন রুশ নিয়ন্ত্রক সংস্থা রসকোমনাদজোর প্রিগোশিনের সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ মিডিয়া আউটলেট বন্ধ করে দেয়। এর পরপরই প্যাট্রিয়টের পরিচালক অবিলম্বে মিডিয়া কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন।

রিয়া ফানের মস্কোভিত্তিক প্রযোজক আন্দ্রে কারপোভ বলেন, ‘গত ৩০ জুন আমাদের সবার চাকরি চলে গেছে। প্রধান সম্পাদক সবাইকে লিখে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় আমার সহকর্মীরা খুবই ক্ষুব্ধ। কারণ, হঠাৎ করে সবার চাকরি চলে গেছে। এখন কী করবে, কেউ জানে না।’

প্রিগোশিনের নেতৃত্বাধীন প্যাট্রিয়ট রাশিয়ায় ‘দেশপ্রেমিক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা চরম জাতীয়তাবাদী ও ক্রেমলিনপন্থী সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করেছিল। প্রিগোশিন ও তাঁর ভাগনার গ্রুপের বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য ও সংবাদ প্রচার করত। প্রিগোশিন তাঁর দীর্ঘদিনের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সেন্ট পিটার্সবার্গের গভর্নর আলেকজান্ডার বেগলোভসহ অনেকের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে প্যাট্রিয়টকে ব্যবহার করেছেন।

আরও পড়ুন

এখন নিজেই ট্রলের শিকার প্রিগোশিন

প্রিগোশিনের নেতৃত্বাধীন সবচেয়ে কুখ্যাত অনলাইন আউটলেট ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি (আইআরএ) প্যাট্রিয়ট গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনলাইনে প্রাতিষ্ঠানিক ট্রলিংয়ের জন্য আইআরএ ব্যাপকভাবে পরিচিত। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠার পর আইআরএ পরিচিতি পায়। বিদ্রোহের পর এখন বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টের নিচে প্রিগোশিনের বিরুদ্ধেই আগ্রাসী কমেন্ট করছেন আইআরএর কর্মীরা।

এদিকে রুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিকে–তে হাজারো ব্যবহারকারী ‘বিশ্বাসঘাতক’ প্রিগোশিনের বিরুদ্ধে ট্রল ও নেতিবাচক কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। মাসখানেক আগেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। প্রিগোশিন ও ভাগনারসংক্রান্ত ইন্টারনেট ট্রল ট্র্যাক করে একটি পর্যবেক্ষণকারী গ্রুপ বলছে, মে মাসের আগে ভিকে–তে প্রায় ১৫ হাজার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রিগোশিনের সুনাম করা হয়েছিল। এখন বেশির ভাগই তাঁর বিরুদ্ধে বলছে। এটা স্পষ্ট যে পুতিন সরকার এসব অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রিগোশিন বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় ও জটিল একটি করপোরেট কাঠামো তৈরি করেছেন। শুধু ভাড়াটে সেনা সরবরাহ নয়, একাধারে সংবাদমাধ্যম, খনি, লজিস্টিক, চলচ্চিত্র, ক্যাটারিংসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেমসন ইউনিভার্সিটির যোগাযোগবিষয়ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড্যারেন লিনভিল ২০১৮ সাল থেকে প্রিগোশিনের আইআরএ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জানান, টুইটারে ১৮০টির বেশি আইআরএ–সম্পৃক্ত ট্রল চিহ্নিত করা হয়েছে। বিদ্রোহের পর এসব ট্রলে প্রিগোশিনের সমালোচনা করা হয়েছে। ড্যারেন বলেন, ‘বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর এসব ট্রল বেড়ে যায়।’

ড্যারেনের মতে, আগে যেহেতু এসব ট্রলে প্রিগোশিনের সুনাম করা হতো, তাই ধারণা করা হয়, এসব তাঁরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর এখন হয়তো ক্রেমলিন নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই পরিস্থিতিতে ড্যারেনের ভাষ্য, ‘এত দিন ট্রলের মাধ্যমে বেঁচে ছিলেন প্রিগোশিন। আর এখন তিনি ট্রলের মধ্য দিয়ে মারা যাবেন।’

আরও পড়ুন

প্রসঙ্গ যখন আফ্রিকা

প্রিগোশিনকে দমন করতে হলে আফ্রিকায় তাঁর করপোরেট চুক্তি বাতিল করা, ব্যবসায় ধস নামানো কার্যকর কৌশল হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। তাঁদের মতে, এই পরিস্থিতিতে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে প্রিগোশিনের খনির ব্যবসায় করা লাভজনক করপোরেট চুক্তির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ক্রেমলিন।

আফ্রিকা থেকে হাজারো ভাড়াটে সেনা সংগ্রহ করেছে ভাগনার গ্রুপ। আফ্রিকার বিরোধপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন রয়েছে হাজারো ভাড়াটে সেনা। সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ রাশিয়ার আফ্রিকান মিত্রদের আশ্বস্ত করেছেন যে আফ্রিকায় মোতায়েন করা ভাগনারের সেনাদের প্রত্যাহার করবে না রাশিয়া।

আফ্রিকায় পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাশিয়ায় চরম চাপে পড়েছেন প্রিগোশিন। বিদ্রোহের পর থেকে তাঁর নেতৃত্বাধীন ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়ে খাবার সরবরাহের চুক্তি একের পর এক হারাতে শুরু করেছে। রুশ সংবাদমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হয়েছে।

রাশিয়ায় একসময় পুতিনের বাবুর্চি হিসেবে পরিচিত ছিলেন প্রিগোশিন। সেখান থেকে তিনি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। পুতিনের আনুকূল্যে এত দিন ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এই সাম্রাজ্য। কিন্তু সময় বদলেছে। পুতিনের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে এখন চক্ষুশূল হয়েছেন প্রিগোশিন।

রুশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রিগোশিনের কোম্পানির বিশাল অঙ্কের ব্যবসা রয়েছে। এর আওতায় রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে, সেনাঘাঁটিতে রসদ সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত প্রিগোশিন। এ ছাড়া আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তানে রুশ সেনাঘাঁটিতে রসদ জোগান দেন তিনি। তাই হঠাৎ করে প্রিগোশিনের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে রসদ নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়বে রুশ বাহিনী।

ভাগনারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডেনিস কোরোতকভ বলেন, ‘বিদ্রোহ–পরবর্তী সময়ে রুশ কর্তৃপক্ষের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সামরিক ঘাঁটির কাজকে ব্যাহত না করেই প্রিগোশিনের সরবরাহ চেইনে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।’

আরও পড়ুন

কোথায় আছেন প্রিগোশিন

বিদ্রোহের পর যুদ্ধবাজ নেতা প্রিগোশিনের অবস্থান নিয়েও রহস্য তৈরি হয়েছে। বিদ্রোহ থেমে যাওয়ার পর বেলারুশে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, বিদ্রোহের কারণে প্রিগোশিনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো তুলে নেওয়া হবে। রক্তপাত এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া।
কিন্তু বেলারুশে যাননি প্রিগোশিন। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কা এর মধ্যে বলেন, ‘ভাগনারপ্রধান প্রিগোশিন বেলারুশে আসেননি। তিনি এখনো রাশিয়ায় রয়েছেন।’ এরপর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, বিদ্রোহের পর প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভাগনারপ্রধান।

প্রিগোশিন রাশিয়ায় কোথায় এবং কী অবস্থায় রয়েছেন, সেসব নিয়ে কিছুই জানা যায়নি। এর মধ্যেই নিজ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে তাঁর বেশির ভাগ স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা শুরুর খবর পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে তাঁর কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে ভাগনারের লোগোর বিশাল একটি স্মারক সরিয়ে ফেলা হয়েছে।  

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন