লন্ডন সম্মেলন কি ট্রাম্পের মন জোগাতে পারবে
ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা করতে গতকাল রোববার যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে জড়ো হয়েছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা। সম্মেলনটির আয়োজক ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।
সম্মেলনে ঘণ্টা দুয়েকের আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার পদক্ষেপ নিতে ইউরোপের নেতারা একমত হয়েছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়েই এ কাজ করতে চান। আর এ লক্ষ্যে চার দফা পরিকল্পনা করা হয়েছে।
চার দফা পরিকল্পনায় আছে—
ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা চালু রাখা। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো অব্যাহত রাখা।
স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যেকোনো শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে অবশ্যই রাখা।
শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ প্রতিরোধে কিয়েভের প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা বাড়ানো।
শান্তি চুক্তি রক্ষাসহ পরবর্তী সময়ে শান্তির নিশ্চয়তা দিতে ইচ্ছুকদের নিয়ে জোট গঠন করা।
সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে ইউরোপীয় নেতাদের নেওয়া সিদ্ধান্তকে আপাতত স্বস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠকে নজিরবিহীন বাগ্বিতণ্ডা হয়। এরপর ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে গতকাল রোববার লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের সম্মেলন হলো।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
তবে লন্ডন সম্মেলন ঘিরে আগেই নানা প্রশ্ন, সংশয় তৈরি হয়। যেমন বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সম্মেলনের গুরুত্ব কতখানি? ইউরোপীয় শক্তির এ সম্মেলন কি কূটনৈতিক গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট, নাকি ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে?
এসব প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ইউরোপের এখনো ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
কিয়ার স্টারমার জানান, যুদ্ধ বন্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশ। এরপর তারা এ পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবে।
ইউক্রেনকে রক্ষা করতে, শান্তির নিশ্চয়তা দিতে আগ্রহীদের নিয়ে একটি জোট গঠন করা হবে বলে জানান কিয়ার স্টারমার। তবে এ প্রক্রিয়ায় কে বা কারা জড়িত হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
কিন্তু যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী শুধু বলেছেন, ইউরোপীয় ও অন্য অংশীদারদের সমন্বয়ে একটি বাহিনী থাকবে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইতিমধ্যে বলেছে, তারা রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে ইউক্রেনের মাটিতে নিজেদের সেনা রাখতে আগ্রহী।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেন বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হলো, সম্ভাব্য আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাকে অত্যন্ত সুরক্ষিত করে তোলা।
ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চায়। এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ব্যাপারে ট্রাম্পকে রাজি করানোর লক্ষ্যে ইউরোপীয় নেতারা নানা প্রস্তাব সামনে এনেছেন।
ট্রাম্পের অবস্থান হলো, কিয়েভের সঙ্গে ওয়াশিংটনের খনিজ চুক্তি হলে ইউক্রেনে মার্কিন খনি সংস্থাগুলোর উপস্থিতি থাকবে। ইউক্রেনে মার্কিন খনি সংস্থাগুলোর উপস্থিতিই দেশটিতে শান্তি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট হবে। অর্থাৎ ট্রাম্প আনুষ্ঠানিক কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে অনিচ্ছুক।
তবে ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ইউরোপে শান্তির জন্য এ প্রচেষ্টায় শক্তিশালী মার্কিন সমর্থন চান।
লন্ডন শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে ইউরোপীয় নেতারা বৈশ্বিক কূটনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা নেতৃত্ব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করার প্রচেষ্টায় এককভাবে ট্রাম্পকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন।
ইউরোপীয়রাও ট্রান্সআটলান্টিক জোট মেরামতের উপায় খুঁজছিল। তবে গত শুক্রবার ওভাল অফিসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির মধ্যকার বাগ্বিতণ্ডার পর এ জোটের অবস্থা বেশ ভঙ্গুর দেখাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয় মিত্রদের আক্রমণ করেছে। ইউরোপের গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জাতিসংঘে ইউরোপীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের উপদেষ্টা ইলন মাস্ক ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লন্ডন শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
কূটনীতিকেরা বলেছেন, ইউক্রেনকে সমর্থনের জন্য ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট সংকল্প সম্মেলনে দেখা গেছে।
তবে সম্মেলনে একই সঙ্গে ট্রাম্পের মন জোগানোর একটা চেষ্টাও ছিল। ফলে ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কাজ করতে একমত হয়েছেন।
ইউরোপীয় নেতাদের এমন পরিকল্পনা সত্ত্বেও অনেক কিছু নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর। অর্থাৎ ইউরোপীয়দের ভাবনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত কি না, এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হতে চায় কি না।
কূটনীতিকেরা বলছেন, জেলেনস্কির সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে ইচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মিশ্র বার্তা পাওয়া গেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-কাজে সম্পৃক্ত হতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।
অন্যদিকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেকোনো যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে জেলেনস্কিকে পদত্যাগ করতে হতে পারে।
তাই লন্ডন সম্মেলনের ফলাফল আপাতদৃষ্টিতে জেলেনস্কির সমর্থনে ইউরোপের একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ। ইউক্রেনের জন্য আরও ইউরোপীয় সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কী করবে, সেটি এখনো অস্পষ্ট। কারণ, ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা জেলেনস্কির প্রতি তাঁদের বিদ্বেষ প্রকাশ করে আসছেন। আর পুতিনের প্রতি তাঁদের আস্থা স্পষ্টতই প্রকাশ পাচ্ছে।