‘অবশেষে আমি ধূমপান ছেড়েছি, আপনারও কেন ছাড়া উচিত’

‘“মা তুমি মরে যাবে।” আমার ছেলে আমাকে ধূমপান করতে দেখে ভয়ে যতবার মাথা চাপড়েছে, সে তুলনায় সিগারেট খাওয়ার পেছনে আমরা যতটা যুক্তি ছিল, তা অতীব নগণ্য। তাই আমি ছেড়েই দিলাম। সময়টা ২০১৯ সাল।’

জুলিয়া ভারজিন। ছেলের এককথায় ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যদের এ নেশা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে নিজের অভিজ্ঞতা তিনি ভাগ করে নিয়েছেন জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের সঙ্গে।

জুলিয়া বলেন, ‘সিগারেট ছেড়েছি তখন দুই মাস। একবারও আর হাতে নিইনি। চিকিৎসক তোবিয়াস রুথর আমার ধূমপান ত্যাগের বিষয়টিতে বেশ রোমাঞ্চিত হলেন। তিনি মিউনিখে লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে তামাক আসক্তি চিকিৎসাসংক্রান্ত বিশেষ বহির্বিভাগ ক্লিনিকের প্রধান।’

জুলিয়াকে চিকিৎসক তোবিয়াস বলেছিলেন, ‘আপনি যখন ধূমপান ছেড়ে দেবেন, দেখবেন আপনার জীবনে অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটবে।’

দ্রুত অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসবে

তোবিয়াস বলেছিলেন, ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার আট ঘণ্টা পর আপনার শরীর অনেক বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করবে। এক কি দুই দিন পর অনেকে আগের মতো ঘ্রাণ ও স্বাদ পায়। দুই সপ্তাহ পর ফুসফুসের কার্যকারিতাও অনেকে বাড়ে, বিশেষ করে খেলার সময় তা চোখে পড়ে।

ধূমপান ছাড়ার পর জুলিয়া আগের মতো নিজেকে ফিট মনে করছেন বলে জানান।
তোবিয়াস বলেন, ‘ধূমপান ছাড়ার পর আপনার অনেক কফ আসতে পারে, যা আগে হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, আপনার ফুসফুস নিজেই সেগুলো পরিষ্কার করে বের করে দিচ্ছে। পুরো পরিষ্কার হতে এক মাস লেগে যেতে পারে। আর এই এক মাস পর আপনার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। এভাবে যখন তিন মাসে পড়বেন, তখন আপনার রাতে ভালো ঘুম হবে। ধূমপায়ীরা ঘুমের মধ্যেও নিকোটিনের অভাব বোধ করে। কিন্তু আপনার তা হবে না। আপনি আরামে টানা ঘুমাবেন। তিন মাস পর আপনার ঘুম স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

ধূমপান ছাড়ার পর আপনার অনেক কফ আসতে পারে, যা আগে হয়নি। এর মানে হলো আপনার ফুসফুস নিজেই সেগুলো পরিষ্কার করে বের করে দিচ্ছে। পুরো পরিষ্কার হতে এক মাস লেগে যেতে পারে।
তোবিয়াস রুথর, আসক্তিবিষয়ক চিকিৎসক, মিউনিখে লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়

তৃতীয় সিগারেট থেকেই বিপদ শুরু

ধূমপান পুরোপুরি ছাড়ার আগে জুলিয়া ভারজিন ভেবেছিলাম, সিগারেট খাওয়া কিছুটা কমিয়ে দিলে হয়তো স্বাস্থ্যের তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু তাঁর ধারণাটি পুরোপুরি সত্য ছিল না। কারণ, দুটির বেশি সিগারেট স্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য যথেষ্ট।

চিকিৎসক তোবিয়াস বলেন, সিগারেট ৩টি থেকে ২০টি মধ্যে হলেই স্ট্রোক ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তবে ক্যানসারে বিষয়টি আলাদা। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি সিগারেটেই সেই ঝুঁকি বাড়ে। যদিও প্রতি দুজন ধূমপায়ীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় তামাক আসক্তির কারণে। আর তাঁদের ৫০ শতাংশই ৭০ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা যান।

জুলিয়া বলেন, ‘তোবিয়াস নিশ্চিত ছিলেন, আমি ৫০ বছর বয়সে ধূমপানের পরিণতি অনুভব করব। তবে আমি সত্যি ছাড়তে পারায় এটি আমার জন্য এক বিশাল অর্জন।’

৯৫ শতাংশই আবার ফিরে যান

জুলিয়ার ভাষ্য, ‘আসক্তিবিষয়ক এই চিকিৎসক মনে করেন, আমার হাত থেকে সিগারেটকে দূরে রাখতে ওষুধ হিসেবে নিকোটিন প্যাচ, সম্মোহন বা আকুপাংচার—এসবের দরকার ছিল না। এ ক্ষেত্রে আমার ইচ্ছাটাই মূল ছিল। এমনকি আমি যেহেতু ২১ বছর বয়স হওয়ার পর ধূমপান শুরু করি, সেটাও নাকি একটি ইতিবাচক দিক ছিল।’

চিকিৎসক তোবিয়াস বলেন, বেশির ভাগ ধূমপায়ী ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করেন। নিকোটিন অত্যন্ত সক্রিয় একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা মস্তিষ্কে নিউরাল সংযোগের বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ফলাফল হচ্ছে, এটি আজীবন আসক্তিতে রূপ নেয়, যা নিছক ইচ্ছাশক্তি দ্বারা খুব কমই কাটিয়ে ওঠা যায়।

দেখা যায়, যাঁরা শুধু নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে এই আসক্তি ত্যাগ করেন, ছাড়ার প্রথম বছরের মধ্যে আবার ৯৫ শতাংশ এ নেশায় ফিরে আসেন।

যদিও প্রতি দুজন ধূমপায়ীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় তামাক আসক্তির কারণে। আর তাঁদের ৫০ শতাংশই ৭০ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা যান।

ধূমপায়ীর মোহ

জুলিয়া বলেন, ‘ধূমপান ত্যাগের পর আবার এ বদভ্যাসে ফিরে আসার একটি কারণ ধূমপায়ীর মোহ বা টান। এটি নিকোটিনের একটি বাজে মনস্তাত্ত্বিক কৌশল। চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন, সিগারেটে আসক্তির পেছনে মানসিক নির্ভরতা বেশ জোরালো কারণ। আমি নিজেকে যাচাই করে দেখলাম, ঠিক তা-ই। সে কারণে আমিও ধূমপানের টানে পড়ে গিয়েছিলাম। বছরের পর বছর আমি বিশ্বাস করেছি, ধূমপান আমাকে শান্ত করবে, মানসিক চাপ দূর করে আমাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।’

চিকিৎসক বললেন, ‘বাস্তবতা হলো প্রতিটি সিগারেট আপনার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয় এবং আপনাকে আরও অস্থির করে তোলে।’

পাভলভের কুকুর

সিগারেটমুক্ত প্রথম সন্ধ্যাটি বন্ধুদের সঙ্গে গান ও ওয়াইনে বেশ অদ্ভুত ছিল। কিছু নেই, এটা ঠিক মনে হয়নি জুলিয়ার। তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমি নিজেকে এটাই বুঝিয়েছি, ধূমপান কেবল নির্দিষ্ট কিছু মুহূর্তের অংশ, যেমন কফির সঙ্গে, ওয়াইনের সঙ্গে বা কোনো বিরতিতে।’

চিকিৎসক তোবিয়াস বলেন, ‘এটি পাভলভের কুকুরের মতো কাজ করে। আপনি কুকুরটিকে কিছু খেতে দিলেন এবং একই সঙ্গে একটি ঘণ্টা বাজালেন। কোনো কোনো সময়ে ওই ঘণ্টাই কুকুরের লালা ঝরার জন্য যথেষ্ট।’

ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এই ঘণ্টা স্থায়ীভাবে বেজে ওঠে। কাজের পর, খাওয়ার পর, বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময়। এ তালিকা চলতেই থাকে। তোবিয়াস বলেন, মূল বিষয়টি হচ্ছে সিগারেট ধূমপায়ীদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।

ফুসফুসের ক্যানসারে প্রতিবছর বিশ্বে মারা যান প্রায় ১৩ লাখ মানুষ
ছবি: সংগৃহীত

আপনি ছাড়তে চান, কিন্তু কীভাবে

ধূমপানের নেশা যিনি ছাড়তে চান, তাঁর জন্য এটা বড় কঠিন হয়ে ওঠে। তোবিয়াস প্রাথমিকভাবে তাঁর রোগীদের আশ্বস্ত করেন, ব্যর্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং এটি সিগারেট ছাড়ারই একটি অংশ। তোবিয়াস বলেন, ‘যখনই কোনো রোগী আমাকে বলেন, তিনি এর মধ্যে পাঁচবার ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। তখন আমি তাঁদের সেই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’
চিকিৎসক আরও বলেন, ধূমপান ত্যাগ করা অনেকটা বাইসাইকেল চালানো শেখার মতো। পড়ে যাওয়া এটির একটি অংশ। গুরুত্বপূর্ণ হলো ওঠে বসা।

একই সঙ্গে কিছু পাল্টে গেছে—এই সংকেত মস্তিষ্ককে দিতে হবে। তোবিয়াসের ভাষ্যমতে, ‘সকালে একেক দিন একেক চেয়ারে বসুন। কফির বদলে চা পান করুন। কর্মস্থলে থাকা গাছপালার স্থান পরিবর্তন করে দিন।’