ঘর পাচ্ছে মোনালিসা

মোনালিসাকে দেখার জন্য একজন দর্শক গড়ে সময় পান মাত্র ৫০ সেকেন্ডছবি: এএফপি

মোনালিসা! সবার কাছে যেন সমান প্রিয়। চিত্রকর্ম ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র কিছু। এর হাসির রহস্য সন্ধানে যুগ যুগ ধরে চলছে কত সব বিশ্লেষণ। পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত প্রতিকৃতি এই মোনালিসা। যেখানে যেতেন, সেখানেই ছবিটি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এর স্রষ্টা লেওনার্দো দা ভিঞ্চি। অনেক গবেষক ধারণা করেন, এটি লিসা দেল জিওকোন্দো নামে ইতালির একজন অভিজাত নারীর প্রতিকৃতি। ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে এই ছবি আঁকা হয়।

এবারের ঘোষণাটি মোনালিসাপ্রেমীদের জন্য সুখবরই আনতে যাচ্ছে বটে। তাঁরা মোনালিসার সঙ্গে একক কক্ষে স্মৃতি উদ্‌যাপন করতে পারবেন! শুনতে অন্য রকম লাগলেও বিষয়টি কিন্তু সত্যি। মোনালিসাকে দেখা যাবে একটি আলাদা সুবিশাল কক্ষে।

মোনালিসা প্রদর্শিত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুঘর ফ্রান্সের প্যারিসের ল্যুভরে। সেখানকার ‘স্টেট রুমে’ অন্যান্য চিত্রকর্মের সঙ্গে কাচঘেরা অবস্থায় প্রদর্শিত হচ্ছে এটি। কিন্তু জাদুঘরটিতে প্রতিদিন যে দর্শনার্থী হয়, তার ৮০ ভাগেরই ভিড় লেগে থাকে শুধু এই এক চিত্রকর্মের সামনে।

সংখ্যার বিচারে রোজকার দর্শনার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজারের মতো! আর এর ৮০ শতাংশ বা ২০ হাজার দর্শনার্থীর ভিড় থাকে মোনালিসার সামনে। এ তথ্য স্বয়ং ল্যুভর জাদুঘরের পরিচালক লোরঁস দে কার। জাদুঘরটিতে বছরে কতসংখ্যক দর্শনার্থী আসেন, তার একটি পরিসংখ্যান বোঝা যাবে গত বছরের সংখ্যার দিকে তাকালেই। ২০২৩ সালে ল্যুভরে প্রবেশের সুযোগ পাওয়া দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ।

মোনালিসাকে আলাদা কক্ষে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে শনিবার সম্প্রচারমাধ্যম ফ্রান্স ইন্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন লোরঁস দে কার। তিনি জানান, দর্শনার্থীদের একটি অংশ কেবল মোনালিসাকে দেখতে ল্যুভরে এসে থাকেন। কিন্তু তাঁদের জন্য সেভাবে স্থানসংকুলান ও সেবার ব্যবস্থা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ করতে পারে না, যা হতাশাজনক। তিনি বলেন, দর্শনার্থীরা মোনালিসার সঙ্গে ছবি তুলে ফ্রেমবন্দী হতে চান। তাঁদের মধ্যে মোনালিসার হাসির সঙ্গে সেলফি তোলার বিশেষ প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু অতি ভিড়ের কারণে সবার পক্ষে মোনালিসার কাছে যাওয়া সম্ভব হয় না।

লোরঁস দে কার বলেন, দর্শকদের এই সংকট উত্তরণে মোনালিসাকে আলাদা কক্ষে স্থানান্তর করা ছাড়া তাঁর কাছে এই মুহূর্তে বিকল্প ভালো কোনো সমাধান নেই।

মোনালিসাকে আলাদা কক্ষে স্থানান্তরের কাজটি কিছুটা এগিয়েও গেছে বলে উঠে এসেছে ল্যুভরের পরিচালকের কথায়। তিনি বলেন, চিত্রকর্মটি আলাদা কক্ষে স্থানান্তরের জন্য ইতিমধ্যে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জাদুঘরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে।

১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে মোনালিসার ছবিটি এঁকেছিলেন ভিঞ্চি। ১৫০৫ সালে তাঁর ডান হাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মোনালিসার অঙ্কন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে বলে গবেষকদের ধারণা। ১৫১৬ সালে ৬৪ বছর বয়সে ভিঞ্চি যখন ইতালি থেকে ফ্রান্সে আসেন, সে সময় ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস চার হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ভিঞ্চির কাছ থেকে মোনালিসাকে সংগ্রহ করেন। রাখেন ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদে। এরপর প্রথম ফ্রান্সিসের জামাতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মোনালিসাকে নিয়ে যান টুইলিরাইসে, নিজের শয়নকক্ষে। ১৮২১ সালে নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর ছবিটি উপহার দেওয়া হয় ল্যুভর জাদুঘরকে।

সেই থেকে মোনালিসা ল্যুভরেই আছে। মাঝে ১৯১১ সালে ল্যুভর থেকে একবার চুরি হয়েছিল মোনালিসা। এই ঘটনার পেছনে আরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো ও কবি গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ারকে দায়ী করা হয়। তাঁদের আদালতে হাজিরও করা হয়। পরে অবশ্য তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে মোনালিসার সন্ধান মেলে। মোনালিসা আবার ল্যুভরে ফেরে ১৯১৩ সালে। মোনালিসার চুরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভিনসেনজো পেরুগিয়া নামে ল্যুভরের একজন কর্মচারী। তিনি ছিলেন ইতালির নাগরিক। তিনি মনে করতেন, ইতালির নাগরিক ভিঞ্চির এই অমর সৃষ্টি ইতালিরই সম্পদ। তাই এটি ইতালিতেই ফিরিয়ে নেওয়া হোক।

মোনালিসার হাসি সম্পর্কে গবেষকেরা বলছেন, এটাই মানুষের হাসি সম্পর্কে প্রথম আঁকা চিত্রকর্ম। যদিও মুখের শেষ দিকের সূক্ষ্ম লাইনগুলো অসম্পূর্ণ থাকে, তবু মনে হয় ঠোঁট হাসছে।

মোনালিসা ও তাঁর হাসি নিয়ে চলছে অনেক বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডও। সর্বশেষ এই কাতারে যোগ হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত হয় মোনালিসাকে ব্যবহার করে এআইযুক্ত র‍্যাপ গান। অভিনয়শিল্পী অ্যান হ্যাথাওয়ের লেখা ও গাওয়া এই গানে মনে হয় মোনালিসা ঠোঁট, চোখ, মুখ নাড়িয়ে র‍্যাপ গান গাইছেন।

মোনালিসাকে আলাদা কক্ষে স্থানান্তর করা হলে লোরঁস দে কারের নামও বসবে ইতিহাসের পাতায়। অবশ্য ইতিমধ্যে তিনি ইতিহাস গড়েছেনও। জাদুঘরটির ২০০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০২১ সালের মে মাসে তিনি জাদুঘরের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

  • তথ্যসূত্র: এএফপি, টাইম