প্রিগোশিনের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, নাকি প্রতিশোধ

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভাগনারপ্রধান প্রিগোশিন
ফাইল ছবি–রয়টার্স

রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন গতকাল বুধবার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে রুশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। দুই মাস আগে তিনি ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভুত্থানের চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তাঁর মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা কীভাবে হলো, কারণই–বা কী—এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসছে।

রাশিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা বলছে, মস্কোর উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। এতে ভাগনারের প্রধান প্রিগোশিনসহ সব আরোহী নিহত হয়েছেন। যুদ্ধে নৃশংস উপায় অবলম্বন এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সাফল্যের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছিলেন যুদ্ধবাজ প্রিগোশিন।

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরও প্রিগোশিন এত দিন বেঁচেছিলেন, তাতেই আমি বিস্মিত হয়েছি
বিল ব্রাউডার, পুতিনের সমালোচক ও রাশিয়ায় সাবেক বিদেশি বিনিয়োগকারী

কী ঘটেছিল

সেন্ট পিটার্সবার্গে ভাগনারের সদর দপ্তরের সামনে প্রিগোশিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন রুশ নাগরিকেরা। ২৩ আগস্ট
ছবি: এএফপি

ব্যক্তিগত এমব্রায়ের জেট উড়োজাহাজে সাতজন যাত্রী ও তিনজন ক্রু ছিলেন বলে রাশিয়ার জরুরি সেবা সংস্থাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন।

রুশ কর্মকর্তারা বলছেন, মস্কো থেকে উড়োজাহাজটি সেন্ট পিটার্সবার্গ যাচ্ছিল। রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় তিভের অঞ্চলের কুজেনকিনো গ্রামের কাছে এটি বিধ্বস্ত হয়। হঠাৎ ফ্লাইট ট্র্যাকিং থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে উড়োজাহাজটি প্রায় ২৮ হাজার ফুট ওপরে উঠেছিল।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসের তথ্যমতে, দুর্ঘটনাস্থলে আট ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া গেছে। উড়োজাহাজটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটি মস্কো থেকে উড্ডয়নের পর আকাশে প্রায় আধা ঘণ্টা ছিল।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিধ্বস্ত বিমানে ভাগনারপ্রধান ছিলেন। মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে উড্ডয়নের পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে উড়োজাহাজটির ফ্লাইট ডেটা আদান–প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই কুজেনকিনো গ্রামের কাছে এটি বিধস্ত হয়।

আসলে কী ঘটেছিল, আমি তা জানি না। তবে আমি এই দুর্ঘটনায় মোটেই বিস্মিত নই
জো বাইডেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আরআইএ নভোস্তির প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, উড়োজাহাজের একটি ডানা নেই। সিএনএন অবশ্য ভিডিওর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। তবে আরআইএ নভোস্তি দাবি করেছে, এটিই সেই এমব্রায়ের জেট। তিভের অঞ্চলে আকাশ থেকে পড়ার মুহূর্তে এই ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

তবে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ এখনো পরিষ্কার নয়। রুশ কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে। দুর্ঘটনাস্থলে তল্লাশি অভিযান চলছে।

বিজ্ঞান ও মহাকাশ নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক মাইলস ও’ব্রিন উড়োজাহাজের নিচে পড়ার ভিডিও পর্যালোচনার পর সিএনএনকে বলেন, ‘এটি খুব দ্রুত ঘুরপাক খেয়ে আকাশ থেকে পড়ছিল। এ সময় দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছিল। সুতরাং মনে হচ্ছে, এতে আগুন ধরে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, উড়োজাহাজের কিছু অংশ নেই।

আরও পড়ুন

মাইলস ও’ব্রিন বলেন, বড় ধরনের অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে এ ধরনের একটি উড়োজাহাজ এমন ভয়ংকর গতিতে নিচে পড়ার কথা নয়।

বর্ষীয়ান এই সাংবাদিক বলছেন, উড়োজাহাজের ভেতরে বা বাইরে শুধু কোনো বিস্ফোরণ ঘটলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হতে পারে উড়োজাহাজের ভেতরে কোনো বিস্ফোরণ ঘটেছে। অথবা এটি লক্ষ্য করে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে, যার আঘাতে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বেসামরিক বিমান চলাচল প্রশাসনের সাবেক নিরাপত্তা পরিদর্শক ডেভিড সোশিও একই সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, উড়োজাহাজটি যখন নিচে পড়ছিল, তখন এতে একটি ডানা ছিল বলে মনে হয়েছে।  

আরও পড়ুন

এটা কি প্রতিশোধ

রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রিগোশিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঠিক দুই মাস পর এই দুর্ঘটনা ঘটল।

প্রিগোশিন ও তাঁর ভাগনার সৈন্যরা মস্কোর উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক ঘাঁটি দখল করেছিল। ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে মস্কোর পথে তখন ভারী অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। তবে প্রিগোশিনের বিদ্রোহী সৈন্যদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার আগে দুইপক্ষে চুক্তি হয়। এরপর প্রিগোশিন ও তাঁর যোদ্ধাদের প্রতিবেশী বেলারুশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

প্রিগোশিনের এই বিদ্রোহ ২৩ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এই অভ্যুত্থানই আবার পিগোশিনকে লক্ষ্য বানিয়ে দিল। কিছু বিশেষজ্ঞ আগেই অনুমান করেছিলেন, যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধবাজ প্রিগোশিনের মৃত্যু হতে পারে। আসলে তিনি এখন ‘অ্যা ডেড ম্যান ওয়াকিং’।

আরও পড়ুন

এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল বলেছিলেন, এই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার সঙ্গে পুতিন জড়িত থাকতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আসলে কী ঘটেছিল, আমি তা জানি না। তবে আমি এই দুর্ঘটনায় মোটেই বিস্মিত নই।’

সিআইএর পরিচালক বিল বার্নস ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। দুজনই পুতিনের দীর্ঘদিনের প্রতিশোধ নেওয়ার ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, ভিন্ন মতাবলম্বী এবং রাশিয়ার সমালোচকদের ভাগ্যেও এমন রহস্যজনক মৃত্যুই ঘটেছে।

রাশিয়ায় এক সময় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী ছিলেন পুতিনের ঘোর সমালোচক বিল ব্রাউডার। পুতিনের সমালোচনার কারণে তাঁকে সে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি বলেন, ‘ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরও প্রিগোশিন এত দিন বেঁচেছিলেন, তাতেই আমি বিস্মিত হয়েছি। ভাগনার গ্রুপের অন্যান্য নেতা ও প্রিগোশিনের মিত্রদের এখন হয় দৌড়ের ওপর থাকতে হবে অথবা আত্মগোপনে যেতে হবে।’

আরও পড়ুন

রাশিয়ার মানুষের প্রতিক্রিয়া কী

প্রিগোশিন ও ভাগনার সেনাদের প্রতি সাধারণ রুশ মানুষের যে সমর্থন রয়েছে, সেটা ব্যর্থ অভুত্থানের সময় দেখা গিয়েছিল। ওই সময়ের ভিডিওতে দেখা যায়, ভাগনার গ্রুপ স্বল্প সময়ের জন্য যেসব শহর দখল করেছিল, সেখানকার বাসিন্দারা উল্লাস প্রকাশ করছেন। তাঁরা ভাগনার সেনাদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রিগোশিনের গাড়ি থামিয়ে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করছেন।

গতকাল মানুষ প্রিগোশিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফুল, মোমবাতি ও ভাগনারের প্রতীক নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে জড়ো হয়েছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ভাগনারের সদর দপ্তর ‘ভাগনার  পিএমসি’–এর বাইরে বিরাট ব্যানার নিয়ে জড়ো হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ব্যানারে লেখা রয়েছে—‘আমরা একসঙ্গে আছি’।

আরও পড়ুন

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সদর দপ্তরের সামনে তরুণ, দম্পতি, কিশোর–কিশোরীসহ প্রচুর মানুষ ভাগনারপ্রধানের প্রতি শোক জানাচ্ছেন।

উল্টো চিত্র ইউক্রেনে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে ভাগনার বাহিনী লড়াই করেছে। সেখানে তাদের বেশ সাফল্যও রয়েছে। ইউক্রেনের মানুষ বলছেন, ভাগনারপ্রধান মারা গেলেও এখানে কোনো চোখের পানি পড়বে না।

ইউক্রেনে দায়িত্বরত সিএনএনের সাংবাদিক নিক প্যাটন ওয়ালশকে পাঠানো খুদে বার্তায় এক ইউক্রেনীয় সেনা লিখেছেন, তাঁরা প্রিগোশিনের মৃত্যুর খবর উদ্‌যাপন করছেন।

আরও পড়ুন