ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল দখলের বৈধতা দিল রাশিয়ার আদালত

যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত রুশ সামরিক যানের ওপর উঠে খেলছে ইউক্রেনীয় শিশুরা। শনিবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের সেইন্ট মাইকেল’স ক্যাথেড্রালের বাইরে
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বাক্ষর করা চুক্তিকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন দেশটির সাংবিধানিক আদালত। অনলাইনে এ আদালতের প্রকাশ করা নথিপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নিজ শহর কিরিভি রিহে আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদের গুদামে পাল্টাপাল্টি হামলার দাবি করেছে উভয়পক্ষ। খবর আল–জাজিরার।

ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, খেরসন, লুহানস্ক ও জাপোরিঝঝিয়া, এই চার অঞ্চলকে গত শুক্রবার রাশিয়ার ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করে চুক্তিতে সই করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এই চুক্তি রুশ ফেডারেশনের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করে এক আদেশে এর বৈধতা দিয়েছেন দেশটির সাংবিধানিক আদালত।

এ চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে পুতিন ইউক্রেনের ৪ অঞ্চলের প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রুশ ফেডারেশনে যুক্ত করেন। এ সময় তিনি বলেছিলেন, খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বাসিন্দারা আজীবনের জন্য রাশিয়ার নাগরিক হয়ে গেলেন। তাঁরা যেকোনো মূল্যে নিজ দেশ রক্ষা করবেন।

ইতিমধ্যে রোববার ইউক্রেনের দিনিপ্রোপেত্রভস্ক অঞ্চলের গভর্নর ভ্যালেন্তিন রেজনিচেনকো বলেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির নিজ শহর কিরিভি রিহে আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। হামলায় একটি স্কুল ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। এ সময় সেখানে আগুন ধরে যায়। পরে তা নেভানো হয়।

জার্মানি, ডেনমার্ক ও নরওয়ে ইউক্রেনের কাছে দূরপাল্লার ‘১৬ স্লোভাক জুজানা-২’ অস্ত্র বিক্রি করবে বলে জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার অংশ হিসেবে আগামী বছর এসব অস্ত্রের সরবরাহ শুরু করা হবে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেন যুদ্ধে আত্মঘাতী ড্রোন দিয়ে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনের বিমানবাহিনী দাবি করেছে, রোববার দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে গুলি করে ইরানের নির্মিত পাঁচটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে তারা। এ ছাড়া বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সহায়তায় ভূপাতিত করা হয়েছে আরও দুটি ড্রোন।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তাদের বাহিনী খারকিভ, জাপোরিঝঝিয়া, মিকোলেইভ, দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র ও কামানের সাতটি গুদাম ধ্বংস করেছে। এ ছাড়া খেরসনের নোভা কালুহা শহরের কাছে এস–৩০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থায় ব্যবহৃত রাডার ধ্বংস করেছে তারা।

অন্যদিকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী বলেছে, চেরনিহিভে রুশ বাহিনীর গোলাবারুদের একটি গুদামে হামলা চালিয়েছে তারা। রাশিয়ার সেনাদের অন্যান্য কমান্ড পোস্ট, গোলাবারুদের গুদাম ও দুটি এস–৩০০ বিমানবিধ্বংসী ব্যাটারিতেও তারা আক্রমণ শুরু করেছে।

উভয়পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি এসব হামলার দাবির সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায়নি।

লিমান হাতছাড়া হওয়ায় পুতিনের মিত্রদের সমালোচনা

প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে রুশ ফেডারেশনে যুক্ত করার চুক্তিতে স্বাক্ষরের এক দিন পর দোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহর লিমানের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঘটনায় তাঁর শক্তিশালী মিত্ররাও সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। এই পরাজয়ের জন্য রুশ সামরিক বাহিনীর নেতাদের সাজা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।

মস্কো থেকে আল–জাজিরার সংবাদদাতা মোহামেদ ভল জানান, ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনায় পুতিনের মিত্রদের সমালোচনা রাস্তাঘাটে রাশিয়ার নাগরিকেরা যা বলছেন, তারই প্রতিফলন। রাশিয়ার মতো ক্ষমতাধর দেশ, যার সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, সেই দেশ এসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম শক্তিধর দেশের কাছে ধরাশায়ী হওয়ায় বিস্মিত তাঁরা।

পুতিনের খুব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন রুশ নাগরিকদের মনোভাব তুলে ধরে বলেন, রুশ জেনারেলরা ‘আবর্জনার টুকরা’। তাঁদের খালি পায়ে মেশিনগান হাতে তুলে সোজা যুদ্ধে পাঠানো উচিত।

লিমান পুরোপুরি রুশ সেনামুক্ত: জেলেনস্কি

প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাঞ্চলীয় লিমান শহরটি পুরোপুরি রুশ সেনামুক্ত করা হয়েছে বলে জানান। দোনেৎস্ক অঞ্চলের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি লিমান থেকে নিজ সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার মস্কোর ঘোষণার এক দিন পর রোববার তিনি এ কথা জানান।

বার্তা আদান–প্রদানের মাধ্যম টেলিগ্রামে পাঠানো এক সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, ‘লিমান পুরোপুরি মুক্ত। আমাদের সেনাদের, আমাদের যোদ্ধাদের ধন্যবাদ।’

ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র দেবে তিনটি দেশ

জার্মানি, ডেনমার্ক ও নরওয়ে ইউক্রেনের কাছে দূরপাল্লার ‘১৬ স্লোভাক জুজানা–২’ অস্ত্র বিক্রি করবে বলে জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার অংশ হিসেবে আগামী বছর এসব অস্ত্রের সরবরাহ শুরু করা হবে।

এই অস্ত্রের সাহায্যে প্রতি মিনিটে ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে একসঙ্গে ৬টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া যাবে। মন্ত্রণালয় বলেছে, অস্ত্রগুলো স্লোভাকিয়ায় তৈরি করা হবে। এ ব্যবস্থার পেছনে সম্মিলিতভাবে ৯ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করবে ওই তিন দেশ।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেন। দেশটি বলেছে, রাশিয়ার হামলা প্রতিহত করতে তাদের ভারী আরও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘দখলদারির’ নিন্দায় ৯ দেশ

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ৯টি দেশের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করছেন, তাঁরা ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার নিজ ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করাকে কখনো স্বীকৃতি দেবেন না।

এক যৌথ বিবৃতিতে দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানেরা বলেন, রাশিয়ার সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় তাঁরা চুপ থাকতে পারেন না। তাঁরা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি তাঁদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছেন।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো হলো চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মন্টেনিগ্রো, নর্থ মেসিডোনিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া।  

পোপের আক্ষেপ ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস রোববার ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘দখলদারি’তে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি এই যুদ্ধ বন্ধ ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে আলোচনা শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন।

পোপ বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতির বিপরীত কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি। এটি পারমাণবিক উত্তেজনার ঝুঁকি ও বিশ্বজুড়ে নিয়ন্ত্রণ–অযোগ্য এবং বিপর্যয়কর পরিণতির আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।