‘যুদ্ধ আমার পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে’

রুশ বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কিয়েভের একটি ভবনে আগুন লেগে যায়। গত জুন মাসে তোলা
ছবি : রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ ১০ মাসে গড়িয়েছে। সময়টা কেমন কেটেছে ইউক্রেনের নাগরিকদের? সাংবাদিক মানসুর মিরোভালেভের দিনপঞ্জিতে উঠে এসেছে সেই চিত্র। আল–জাজিরায় প্রকাশিত হয়েছে মানসুর মিরোভালেভের দিনপঞ্জি। তাতে তিনি লিখেছেন, যুদ্ধ আমার পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ আমার সৎ বোনের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে ছিন্ন করে দিয়েছে। ২০ বছর আগে আমাদের বাবা গত হয়েছেন। আমার বোন বসবাস করেন রাশিয়ার একটি বড় শহরে। আমি এ লেখায় তাঁর নাম লিখছি না। কারণ, ইউক্রেনীয়দের সম্পর্কে যে ধারণা তিনি পোষণ করেন, একদিন হয়তো তাঁর সে ভুল ভাঙবে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে, আমাদের মাত্র দুবার যোগাযোগ হয়েছে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা করে রাশিয়া। যুদ্ধের প্রথম দিনে তিনি আমাকে বার্তা পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘কেমন আছ?’ আমি তাঁকে লিখি, ‘আমি কিয়েভে আছি।’ এরপর আর তাঁর কোনো জবাব পাইনি।

আমার সৎবোনকে আমি হয়তো আরও কিছু বলতে পারতাম। আমি হয়তো তাঁকে বলতে পারতাম, অনেক দূরে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। যা শুনে হয়তো তাঁর অ্যাড্রেনালিন পূর্ণ হয়ে উঠত, হয়তো সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই তিনি বলতে পারতেন, কোনো গর্তে লুকিয়ে পড়ো!

ওই দিন বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আমি ও আমার ৮১ বছর বয়সী মা একটি সাবওয়ে স্টেশনে পুরো রাত পাতলা রাবারের বিছানায় বসে কাটিয়েছি। আমরা ঘুমাতে পারিনি। কারণ, হাজারো মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার আর কথাবার্তা আমাদের জাগিয়ে রেখেছে। শিশুদের কান্না, পোষা প্রাণীর চিৎকার আমাদের জাগিয়ে রেখেছে। সেখানে দেখেছি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের সিগারেট ফোঁকা, দুই আরব শিক্ষার্থীর জায়নামাজ বিছিয়ে বসে থাকার, নামাজ পড়ার দৃশ্য।

এসব কিছুই আমার বোনকে লিখতে পারিনি। আমি আমার ফ্রিজে খাবার মজুত করার এবং সম্ভাব্য স্থানান্তরের পরিকল্পনার চিন্তায় ব্যস্ত ছিলাম।

রুশ সৈন্যরা ওই সময় কিয়েভের ঠিক উত্তর দিকটায় হামলা চালাচ্ছিল। ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক নানা মাধ্যমে জানতে পারছিলাম, মস্কোর সেনারা শত শত মানুষকে হত্যা করছে ও নির্যাতন চালাচ্ছে।

ইউক্রেনীয় ফ্যাসিবাদ

আমার সৎবোন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পছন্দ করেন না। তিনি একই সঙ্গে সর্বশেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকেও ঘৃণা করেন। কারণ, গর্বাচেভের কারণেই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছিল। তিনি জানেন, আমাদের দাদাকে ১৯৩৭ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আমাদের বাবাকে অনেক বছর এতিমখানায় কাটাতে হয়েছে। কারণ, আমার দাদির বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনে তাঁকে জেলখানায় পুরে রাখা হয়েছিল।

রুশ বাহিনী এখনও ইউক্রেনের রাজাধানী কিয়েভে হামলা অব্যাহত রেখেছে। গত নভেম্বরে
ছবি : রয়টার্স

কিন্তু আমার বোন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈশ্বিক ক্ষমতা হারানোর অতীত স্মৃতিচারণ করে বেশি দুঃখ পান।

আমার বোনের দৃঢ় বিশ্বাস, পশ্চিমারা রাশিয়াকে টুকরা টুকর করতে চায় এবং এই দেশের খনিজ সম্পদ লুট করে নিয়ে যেতে চায়।

যুদ্ধের ছয় মাস পর হওয়ার পর আমার বোন আবার খুব সাধারণ একটি বার্তা পাঠিয়ে জানতে চান, আমরা কেমন আছি? আমি তাঁকে জবাব দিই, ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে রুশ সৈন্যদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বোন লিখেছিল, রাশিয়ায় বসবাসরত আমার মেয়ে, ভাগনে–ভাতিজিসহ অন্য শিশুরা ইউক্রেনের পতাকা আঁকছে, যুদ্ধ নিয়ে কবিতা লিখেছে, যা আমাকে গর্বিত করেছে।
বোনকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমার চারপাশে যুদ্ধের পক্ষে কত শতাংশ রুশ রয়েছেন? তিনি বলেছিলেন, অনেকেই চায় যুদ্ধ শেষ হোক। আমি তার কথা শুনে স্বস্তি পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এটা যুক্তিপূর্ণ কথা।

কিন্তু এরপর আমার বোন যা শোনালেন, তা যেন ক্রেমলিনের কোনো বই থেকে তুলে ধরা কোনো কথা। অনেক রুশ সেনা তাঁর শহরের হাসপাতালগুলোতয় ভর্তি হয়েছেন। তিনি শুনেছেন, এসব সেনার অনেককেই খোজা করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর চোখে এগুলো ‘নাৎসিদের নৃশংসতা’।

আমি বোনকে প্রশ্ন করেছি, ‘নাৎসি কোথায় পেলে?’ তিনি উত্তরে লিখলেন, ‘ইউক্রেনে নাৎসি ভরা।’

ইউক্রেনকে নাৎসিমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে ‘বিশেষ অভিযান’ চালানোর কথা বলেছিল মস্কো। আমার বোনের কথায় ক্রেমলিনেরই কথার সুর। আমি তাকে লিখে দিলাম ‘বাই কটন কোট।’ এরপর তাঁকে ব্লক করে দিয়েছি। তাঁর সঙ্গ যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি।
রাশিয়ায় ‘কটন কোট’ কথাটি সস্তা অর্থে ব্যবহার করা হয়। এটি রাশিয়ার সবচেয়ে সস্তা শীতের পোশাক। এটি কারাগারের পোশাকের সমতুল্য বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া যাঁরা মস্কোর তুলে ধরা সব কথা বিশ্বাস করেন, তাঁদের বোঝাতেও এই কথাটি ব্যবহার করা হয়।

কিয়েভের ৪৩ বছর বয়সী এক নির্মাণ ব্যবস্থাপক মিকোলাই ট্রফিমেনকো। তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘আমি একসময় কটন কোট ছিলাম।’

মিকোলাই বলেন, ‘আমি একদিন রুশ টিভি দেখা শুরু করলাম। সেখানকার বিখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব সলোভায়োভের অনুষ্ঠান দেখলাম। ভাবলাম, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তারা কী বলছে শুনি। এক সময় খেয়াল করলাম, তাদের কথাতেই সায় দিয়ে আমি মাথা নাড়ছি।’
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের ইন্টারনেট সেবাদাতারা রুশ গণমাধ্যম দেখানো বন্ধ করে দেয়। এতে তিনি রুশ টিভি দেখা বন্ধ করতে বাধ্য হন। মিকোলাই বলেন, রুশ টিভি দেখা বন্ধ করার পর আমি যেন জেগে উঠলাম।

কিন্তু এখনো মিকোলাইয়ের মতো ইউক্রেনের অনেক নাগরিক রুশদের কথাবার্তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত এক সেনা বলেছেন, তাঁর বৃদ্ধ মা তাঁকে বলেছেন, এ পরিস্থিতি দনবাসের সন্তানদের রক্তের শাস্তি। তিনি মূলত ইউক্রেনীয় সেনাদের গোলাগুলির দিকে ইঙ্গিত করে এসব কথা বলেন।

রুশবিরোধী এক ব্যক্তি বলছিলেন, তিনি যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন ছেড়ে আর্মেনিয়া গেছেন। তিনি বৃদ্ধ মাতা–পিতার সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁরা ইউক্রেনের লুহানস্কে বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বসবাস করেন।

উজবেকিস্তানে বসবাসরত এক রুশ নারী তাঁর মা–বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার সময়ও একই কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার কেবল মা–বাবা সেখানে রয়েছে।’

অনেক দেরি হয়ে গেছে

আমার বোন জানে, আমি চার বছর ধরে ইউক্রেনে বাস করছি। আমি ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা ও ২০১৪ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমার বোন কখনো আমার কাছে ইউক্রেনের মাটিতে বিস্ফোরণ, ভয়, মৃত্যু ও জেতার আকাঙ্ক্ষার মধ্যেও ঠিক কী ঘটছে, তা জানতে চায়নি।

আমার বোনের কাছে আমার চেয়ে টেলিভিশনই বেশি প্রিয়। কিন্তু যখন যুদ্ধ শেষ হবে, তিনি তখন হয়তো যুদ্ধ নিয়ে তাঁর ভুল বুঝতে পারবেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার খবরটিও তিনি হয়তো টিভিতেই শুনবেন।

কিন্তু তখন যদি বোন দুঃখ প্রকাশ করেন, আমি কী সাড়া দেব?