মশা-ই নিধন করবে মশা

মশা ধ্বংস করবে গবেষণাগারের পুরুষ মশাছবি: ডয়চে ভেলের ভিডিও থেকে নেওয়া

‘মশা মারতে কামান দাগা’—এই প্রবাদ আমরা শুনেছি। কিন্তু ‘বিষে বিষক্ষয়’-এর মতো মশা কাজে লাগিয়ে মশা মারা গেলে কেমন হয়? সুইজারল্যান্ডে একটি প্রকল্পের আওতায় ঠিক সেই চেষ্টাই চালানো হচ্ছে।

সুইজারল্যান্ডের একটি গবেষণাগারে এশিয়ান টাইগার প্রজাতির মশার সম্ভার দেখার মতো। লার্ভা থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের মশার কোনো অভাব নেই। ইউরোপের অন্য কোনো মানুষের বোধ হয় গবেষক এলেওনোরা ফ্লাসিওর মতো টাইগার মশার আচরণ সম্পর্কে এতটা গভীর জ্ঞান নেই।

দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পর এলেওনোরা এবার অসাধারণ এক পরীক্ষা শুরু করছেন। তিনি একেবারে নতুন পদ্ধতিতে এই মশার দ্রুত বংশবৃদ্ধির মোকাবিলা করতে চান। নির্বীজ পুরুষ মশা ছেড়ে তিনি সেই লক্ষ্য পূরণের পরীক্ষা চালাচ্ছেন।

সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণে ছবির মতো দেখতে মরকোটে এলাকায় গবেষকেরা গত বছর থেকে ২০ লাখ এশিয়ান টাইগার প্রজাতির মশা ছাড়ছেন।

গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এলেওনোরা ছোট ওই গ্রামের প্রায় ৭০টি জায়গায় প্রতি সপ্তাহে কিছু মশা ছাড়ছেন। তবে লাখ লাখ মশা ছাড়া হলেও গ্রামের বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এলেওনোরা বলেন, ‘আসলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এগুলো পুরুষ মশা, যা মানুষকে কামড়ায় না। শুধু উড়ে বেড়ায়। কয়েক দিন পরেই মরে যায়।’

পুরুষ মশার এত কম আয়ুর কারণ স্পষ্ট। নির্বীজ করার প্রক্রিয়া, গবেষণাগারের ধকল ও পরিবহনের কারণে সেগুলো বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে আয়ু কম হওয়া সত্ত্বেও মাদি বা নারী মশার কাছে সেগুলো আকর্ষণীয়। নির্বীজ পুরুষ মশার সংখ্যা বিশাল হওয়ায় মাদি মশাগুলো তাদের এড়িয়েও চলতে পারে না।

এলেওনোরা ফ্লাসিও বলেন, নির্বীজ করা মশা মাঠে চরে বেড়ানো স্বাভাবিক মাদি মশার সঙ্গে মিলিত হয়। মিলন ঘটলে মাদি মশা সারা জীবন আর সন্তান ধারণ করতে পারে না।

এভাবে শেষ পর্যন্ত টাইগার মশার গোষ্ঠীর বিনাশ করা যেতে পারে। পরীক্ষামূলক এলাকায় টাইগার মশার সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমানোই এলেওনোরার লক্ষ্য।

মশা বিনাশ করবে গবেষণাগারের পুরুষ মশা

ইতালির বোলোনিয়া শহরে কৃষি ও পরিবেশ কেন্দ্রে নির্বীজ পুরুষ মশার প্রজনন ঘটানো হয়। ডিম পাড়ার সময়েই সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়। খাঁচার মধ্যে মশার মিলন ঘটে। মাদি মশাকে নিয়মিত পশুর রক্ত খাওয়ানো হয়। কারণ, রক্ত না চুষে খেলে সেগুলো ডিম তৈরি করতে পারে না।

সেই ডিম এক সপ্তাহের মধ্যেই লার্ভায় পরিণত হয়, তারপর পিউপা বা গুটিপোকার রূপ নেয়। এই স্তরেই তথাকথিত ‘ডাইমেনশন অ্যানালিসিস’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরুষ ও মাদি আলাদা করা হয়। পুরুষ মশা মাদি মশার তুলনায় আকারে ছোট। ফলে শুধু চেহারার ভিত্তিতেই সেগুলোকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আলাদা করা যায়। পিউপাগুলোকে পানির মধ্যে ফেলে এক্স–রে করা হয়।

ফলে প্রজনন অঙ্গগুলো সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া দেখায়। এভাবে পুরুষ মশা নির্বীজ হয়ে পড়ে, তবে প্রাণে বেঁচে যায়। এই প্রক্রিয়া অবশ্য এখনো খুবই ব্যয়বহুল। এক হাজার নির্বীজ মশার দাম প্রায় ৬০ ইউরোর মতো। ফলে এবার পরীক্ষার জন্য প্রায় দুই লাখ ইউরো ব্যয় হচ্ছে।

তবে পরীক্ষা সফল হলে এবং আরও বড় আকারে এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ শুরু হলে ব্যয় অনেকটা কমে যাবে।

এলেওনোরা ফ্লাসিও বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া অনেক সস্তা হয়ে যাবে। বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখা দিলেই ব্যয় কমে যাবে। অর্থাৎ এই প্রযুক্তি তেমন ব্যয়বহুল হবে না। বড় আকারে কাজে লাগালেই ব্যয় কমে যাবে।’

এই প্রক্রিয়া সফল হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকল্পটি আরও এগিয়ে নেওয়া হবে। বিশেষ করে যেসব দেশে টাইগার প্রজাতির মশা মানুষের জীবন বিপন্ন করছে, সেখানে এই প্রক্রিয়া কাজে লাগবে।