জ্বালানিসংকট: বিভিন্ন দেশে বাড়ছে সৌর প্যানেলের চাহিদা

সৌর প্যানেল ফটোভোলটাইক সেলের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো শোষণ করে থাকে
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

ইউক্রেনে রুশ অভিযানকে কেন্দ্র করে জ্বালানিসংকটে আছে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এর সঙ্গে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও খরা পরিস্থিতি সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়ে ইউরোপের  বিভিন্ন দেশের সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো এবং মজুত বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। বেড়েছে জ্বালানির বিলও। গ্যাস ও বিদ্যুতের বর্ধিত খরচ থেকে বাঁচতে এসব দেশের অনেকেই এখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে থাকেন পরিবেশবিদেরা। সেদিক থেকে সৌর প্যানেল ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। সৌর প্যানেল ফটোভোলটাইক সেলের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো শোষণ করে থাকে। এ ফটোভোলটাইক সেলই সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে। এ প্রক্রিয়ার কারণে প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত  বিদ্যুতের মূল নেটওয়ার্কের ওপর চাপ কম পড়ে। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় এবং বিদ্যুতের বিলের পরিমাণ কমে।

জার্মানিতে সৌর প্যানেল স্থাপন বেড়েছে ২২ শতাংশ

গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর জার্মানিসহ ইউরোপীয় অন্য দেশগুলোয় গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। জার্মানির বাসিন্দাদের অনেকের আশঙ্কা, শীতকালে পুরোপুরিভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে মস্কো। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে সংকট ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে জার্মান সরকার। দেশটির কর্মকর্তারা জনগণকে জ্বালানি খরচ কমানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।

এমন অবস্থায় সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছেন দেশটির জনগণ। দেশটির নবায়নযোগ্য জ্বালানিশিল্প–সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোয় বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। তাদের সরবরাহব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। জার্মান সোলার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জার্মানিতে সৌর প্যানেল স্থাপন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ বেড়েছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে এর ব্যবহার বাড়ছে।

শিল্প ও জ্বালানিবিষয়ক ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান শেনাইদা ইলেকট্রিক (এসবিজিএসএফ) বলেছে, জার্মানিতে তাদের তৈরি সৌরচালিত হিটিং সিস্টেমের (শীতকালে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা) চাহিদা বেড়ে গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

একইভাবে জার্মান সৌর ব্যাটারি বিপণন প্রতিষ্ঠান সোনেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অলিভার কোচ বলেছেন, গত বছরের তুলনায় ‘দ্বিগুণের বেশি’ ক্রয়াদেশ আছে তাঁদের কাছে। কারণ, জনগণের মধ্যে নিজেদের বাড়িঘরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের আগ্রহ বাড়ছে।

সিএনএনকে দেওয়া বিবৃতিতে কোচ বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চাহিদা আরও বেড়েছে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে উৎপাদনের সক্ষমতা ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে।

স্মার্ট ফ্লাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবার্ট সওইয়া বলেন, সৌর প্যানেলের চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে চলতি বছর বিক্রির পরিমাণ চার গুণ হওয়ার আশা করছেন তাঁরা।
রবার্ট সওইয়ার ভাষ্যমতে, ‘জার্মানিতে ২০২১ সালজুড়ে আমরা যতটা না ব্যবসা করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসা করেছি ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে।’

জার্মানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্মার্ট ফ্লাওয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিম গর্ডন মনে করেন, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ সৌর প্যানেলের দিকে ঝুঁকছেন। সিএনএনকে তিনি বলেন, জ্বালানিনিরাপত্তা নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন। কোনো স্বৈরাচারী একনায়ক হয়তো গ্যাসলাইনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেন এবং জ্বালানি বন্ধ করে দিতে পারেন; তবে কারোরই সূর্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষমতা নেই।

যুক্তরাজ্যে সপ্তাহে তিন হাজারের বেশি সৌর প্যানেল স্থাপিত হচ্ছে

যুক্তরাজ্যে সম্প্রতি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির দাম আগামী অক্টোবর মাস থেকে ৮০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে দেশটির জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফজেম। সে অনুযায়ী, অক্টোবর থেকে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দাদের গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাবদ বছরে অন্তত ৩ হাজার ৫৪৯ পাউন্ড গুনতে হবে। জানুয়ারি মাসে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় দেশটিতে সৌর প্যানেলের চাহিদা খুব বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য সংস্থা সোলার এনার্জি ইউকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে তিন হাজারের বেশি সৌর প্যানেল স্থাপিত হচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে এ সংখ্যা ছিল সপ্তাহে এক হাজার।

সৌর প্যানেল বিপণনকারী একটি প্রতিষ্ঠান বলেছে, চলতি মাসে সোলার প্যানেল নিয়ে তাদের কাছে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন তথ্য চাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি সোলার এনার্জির প্রধান নির্বাহী ক্রিস হেওয়েট বলেন, ব্রিটিশ ভবনগুলোর ছাদে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সৌর প্যানেল স্থাপন করা হচ্ছে।

সৌর প্যানেল স্থাপন করা হচ্ছে
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাজ্যে সৌর প্যানেল স্থাপনের খরচ

যুক্তরাজ্যে এক দশক আগে পুরোনো ধাঁচের একটি সৌর প্যানেল ব্যবস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রায় ২০ হাজার পাউন্ড খরচ হতো। পরবর্তী সময়ে সোলার প্যানেল স্থাপনের খরচ ৬০ শতাংশ কমে আসে।

দ্য রয়েল ইনস্টিটিউশন অব চার্টার্ড সার্ভেয়ারসের তথ্য অনুযায়ী, একটি মানসম্পন্ন সৌর প্যানেল স্থাপনের জন্য ৯ হাজার থেকে ১১ হাজার ৭০০ পাউন্ড পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে। আর সোলার এনার্জি ইউকে বলেছে, তিন শয়নকক্ষের একটি বাড়ির জন্য ৩ দশমিক ১ কিলোওয়াট শক্তির সৌর প্যানেল স্থাপনে ৩ হাজার ৯২৫ পাউন্ড খরচ হয়ে থাকে।

সৌর প্যানেলগুলো কী পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তা ওই ব্যবস্থার ধরন ও আকারের ওপর নির্ভর করে। সোলার এনার্জি ইউকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রচলিত বাড়িগুলোয় সৌর প্যানেল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বছরে ৩০০ পাউন্ডের বেশি বিদ্যুৎ বিল বাঁচানো সম্ভব। যেসব বাড়িকে শীতকালে গরম রাখতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোয় ৯০ পাউন্ড পর্যন্ত বিদ্যুৎ খরচ বাঁচানো সম্ভব; যদিও দেশটিতে শীতকালে বেশির ভাগ বাড়িকে গরম রাখতে গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

অন্য দেশেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে

শুধু জার্মানি বা যুক্তরাজ্যই নয়, অন্য দেশগুলোও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে। চলতি মাসে অস্ট্রিয়ার জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী লিওনোর গেওয়েসলার রাশিয়ার গ্যাসের ওপর তাঁর দেশের নির্ভরশীলতা কমাতে আরও বেশি করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রকল্প নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতে, জীবাশ্ম জ্বালানিকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সে কারণে এ ধরনের জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো জরুরি।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর সৃষ্ট জ্বালানিসংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে চরম গরমজনিত আবহাওয়া ও খরার পরিস্থিতি। গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটা বড় অংশজুড়ে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সে সময় নিউইয়র্ক ও টেক্সাসের বাসিন্দাদের বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে বলা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে খরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় খালের ওপর সৌর প্যানেল বসিয়ে ছাউনি তৈরি করা হচ্ছে। সেন্ট্রাল ক্যালিফোর্নিয়ার টারলক ইরিগেশন ডিস্ট্রিক্ট (টিআইডি) খালের তিনটি অংশে ৮ হাজার ৫০০ ফুটের সৌর প্যানেল স্থাপন করা হবে। আশা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে এবং খালের পানির বাষ্পীভূত হওয়া ঠেকানো যাবে।
সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, সিবিএস