ফ্রান্সে সরকারের পতন ইউরোপের জন্য কেন গভীর উদ্বেগের

পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে গেছেন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়েছবি: রয়টার্স

ফ্রান্সের পার্লামেন্টে গতকাল বুধবার অনাস্থা ভোটে বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতারা সমর্থন জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ের সরকারের পতন হয়েছে। সরকারপ্রধানের পদে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র মাস তিনেকের মাথায় সরে যেতে হচ্ছে তাঁকে। গত সোমবার দেশটির সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা খাটিয়েছিলেন তিনি।

কিছুদিন ধরেই ফ্রান্সে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছিল। চাপে ছিল মিশেল বার্নিয়ের সরকার। দেশের পরবর্তী জাতীয় বাজেট পাস করানো নিয়ে অচলাবস্থা আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতারা বার্নিয়ের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলেন।

ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনীতি এখন দেশটির নাগরিকদের জন্যই শুধু গভীর উদ্বেগের নয়, বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপে সম্ভাব্য অস্থিরতা তৈরির পেছনেও রয়েছে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।

ফ্রান্স ও জার্মানির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এরই মধ্যে জোট হিসেবে ইইউকে প্রভাবিত করেছে। এ অবস্থায় সম্প্রসারণবাদী ও আক্রমণাত্মক ক্রেমলিনের সামনে নিজেদের শক্তি এবং ঐক্য বজায় রাখার প্রতিজ্ঞা ইউরোপ দেখাতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

জার্মানির পাশাপাশি ফ্রান্সকে ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আদর্শিক ও রাজনৈতিক অশ্বশক্তির ‘মোটর’ (চালকশক্তি) হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু এই ‘মোটর’ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

দুই দেশের মধ্যে ফ্রান্সই শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধে বিভক্ত ও লক্ষ্যচ্যুত নয়। সম্প্রতি জার্মানিতেও বৈরিতায় জড়ানো জোট সরকারের পতন হয়েছে। এর জেরে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে আগাম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

দুই দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এরই মধ্যে জোট হিসেবে ইইউকে প্রভাবিত করেছে। এ অবস্থায় সম্প্রসারণবাদী ও আক্রমণাত্মক ক্রেমলিনের সামনে নিজেদের শক্তি এবং ঐক্য বজায় রাখার প্রতিজ্ঞা ইউরোপ দেখাতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

আবার ইউক্রেনের পাশে অবিচলভাবে থাকার প্রতিশ্রুতি ইউরোপ সামনের দিনগুলোতে রক্ষা করতে পারবে কি না, উঠছে সে প্রশ্নও। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি কিয়েভকে অব্যাহতভাবে দিয়ে চলা মার্কিন সামরিক সহায়তা কমিয়ে দেন বা এমনকি বন্ধ করে দেন, সে ক্ষেত্রে ইউরোপ কী করবে, আছে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা।

সর্বোপরি, যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ফ্রান্সই হলো ইউরোপের একমাত্র বড় সামরিক শক্তি। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ফিরে আসাও অনেকটা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ইইউ ও ইউরোপকে। কেননা, ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি এবং ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যয় (অপর্যাপ্ত) নিয়ে ট্রাম্পের ক্ষোভ কীভাবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিস্ফোরিত হয়, সেটি একটি দেখার বিষয়।

ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে ইইউতে চলছে নেতৃত্বের সংকট। রাডারবিহীন অবস্থায় পথচলা শুরুর বিষয়টি অনুভব করতে শুরু করেছে এ জোট। ইউরোপের দেশে দেশে আরও বেশি স্বৈরশাসকের উত্থান ঘটছে। হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ায় রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল নেতাদের আবির্ভাব ঘটেছে। অন্যদিকে দেশের ভেতরের অস্থিরতায় দুর্বল হচ্ছে এবং লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়ছে ফ্রান্স ও জার্মানি।

ফ্রান্সের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হওয়ার দৃশ্যত লক্ষণ নেই। প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ নতুন আরেকজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তবে এরপরও পার্লামেন্ট তিনটি রাজনৈতিক ব্লকে বিভক্ত হয়ে থাকবে। সংস্কার ও নতুন বাজেট নিয়ে ব্লকগুলো একে অপরকে জিম্মি করার ক্ষমতা রাখবে।

ফ্রান্সে বর্তমানে যা ঘটছে, বহির্বিশ্বে তার প্রভাব ফেলার আরও কারণ আছে। ইউরোজোনের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ফ্রান্স। দেশটির বাজেট ঘাটতি ইউরোপের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। একইভাবে ফরাসি সরকারের ঋণও ইউরোপকে ভাবাচ্ছে।

ফ্রান্সের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে করদাতারা জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে চিন্তিত। ইউরোজোনের বাকি অংশেও রয়েছে এমন অস্বস্তি। রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইউরোর মান কমার আশঙ্কা রয়েছে।

ইতিমধ্যে সমস্যায় রয়েছে ইউরোপের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি জার্মানিও।

আরও পড়ুন

‘ফায়ারিং লাইনে’ মাখোঁ

সব মিলিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখোঁ নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন।

অনাস্থা ভোটের মুখে পড়ার আগে মাখোঁর প্রধানমন্ত্রী বার্নিয়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে আইনপ্রণেতাদের সতর্ক করে দেন। সেই সঙ্গে দেশকে দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখার এবং তাঁকে ও তাঁর ব্যয় সংকোচন বাজেট সমর্থন করার অনুরোধ জানান। তবে মাখোঁর সুর ছিল ভিন্ন।

দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ বলেন, ‘এসব বলে জনগণকে ভয় পাইয়ে দেওয়া উচিত নয় আমাদের। আমাদের অর্থনীতি মজবুত আছে।’ তিনি আরও বলেন, ফ্রান্স একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র। এ দেশে অনেক সংস্কার করা হয়েছে। দেশে স্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান রয়েছে।

অনাস্থা ভোট সামনে রেখে সৌদি আরব থেকে প্যারিস ফেরার সময় এসব কথা বলেন মাখোঁ। কিন্তু মাখোঁ যা-ই বলুন, তিনি নিজেও রয়েছেন ‘ফায়ারিং লাইন’–এ দাঁড়িয়ে।

ফরাসি পার্লামেন্টের বর্তমান অচলাবস্থা চলতি গ্রীষ্মে তাঁর ডাকা একটি আগাম নির্বাচনের ফলাফল হিসেবে দেখা দিয়েছে। ওই নির্বাচনে তাঁর দল রেনেসাঁ বেশ খারাপ করেছে।

আরও পড়ুন

ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী, অন্তত এক বছরের মধ্যে কোনো নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা যাবে না। এর অর্থ, আগামী বছরের গ্রীষ্ম বা শরতের আগে কোনো নতুন ব্যয়সাশ্রয়ী বাজেট প্রণয়নের সম্ভাবনা নেই। এমনকি এর মধ্যে কোনো নতুন নির্বাচনে যদি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ফলাফল বেরিয়েও আসে। অবশ্য জনমত জরিপে এমন ফলাফল বেরিয়ে আসার আভাস নেই।

এমন পরিস্থিতিতে মাখোঁর অনেক রাজনৈতিক বিরোধী তাঁর পদত্যাগের জন্য ক্রমে আরও বেশি সোচ্চার হচ্ছেন। তাঁদের দাবি, তাঁর পদত্যাগ দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটাবে।

নানা জটিলতার মুখে ওই দাবি মেনে মাখোঁ যদি এখন পদত্যাগ করেন, তবে ৩০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ডাকতে হবে। এতে কট্টর ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‌্যালির (আরএন) নেতা লা পেনের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে এবং তাতে তিনি জিততেও পারেন।

এককথায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ফ্রান্সের ভেতরে এবং বাইরে সামনে কী ঘটতে চলেছে, তা দেখার অনেক কিছু রয়েছে।