যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মিছিল করা হামজা ইউসেফ স্কটল্যান্ডের ক্ষমতায় বসছেন
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিশ্বব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে দেয়। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দুটি ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ যুদ্ধ দেখে বিশ্ববাসী। একটি আফগানিস্তানে, অন্যটি ইরাকে। শুধু বিশ্বব্যবস্থা নয়, স্কুলপড়ুয়া এক কিশোরের মনোভাবও বদলে দেয় এই হামলা ও যুদ্ধ।
বলা হচ্ছে হামজা ইউসেফের কথা। গতকাল সোমবার স্কটল্যান্ডের ক্ষমতাসীন স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) নেতা নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হামজা। নিকোলা স্টার্জেনের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন তিনি। ব্রিটেনের বড় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রথম মুসলিমপ্রধান হামজা।
আমার পূর্বপুরুষেরা যখন স্কটল্যান্ড আসেন, তখন তাঁরা ঠিকমতো একটি ইংরেজি শব্দ বলতে পারতেন না। তাঁরা হয়তো কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি, তাঁদের উত্তরসূরি একদিন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার হবে।
মাত্র ৩৭ বছর বয়সের হামজা এখন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নতুন আরেকটি ইতিহাস গড়তে চলেছেন এই অভিবাসীর সন্তান।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জন্ম হামজার। তবে তাঁর পূর্বপুরুষেরা গত শতকের ’৬০-এর দশকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে স্কটল্যান্ডে গিয়েছিল। হামজার বাবা মুজাফফর ইউসেফের জন্ম পাকিস্তানে। মা সায়িস্তার জন্ম কেনিয়ায়।
এসএনপির নেতা নির্বাচিত হয়ে হামজা বলেছেন, ‘আমার পূর্বপুরুষেরা যখন স্কটল্যান্ডে আসেন, তখন তাঁরা ঠিকমতো একটি ইংরেজি শব্দ বলতে পারতেন না। তাঁরা হয়তো কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি, তাঁদের উত্তরসূরি একদিন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার হবে।’
হামজার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে ওঠে স্কুল পড়ার সময়ই। ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলা, ইরাক-আফগান যুদ্ধের ডামাডোলে তখন পুরো বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিমবিরোধিতা বাড়ছে। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব চরম রূপ নিয়েছে। ওই সময় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর হাচসন্স গ্রামার স্কুলের এক সহপাঠী তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘মুসলিমরা আমেরিকাকে কেন ঘৃণা করে?’
এই প্রশ্ন হামজাকে ভাবিয়ে তোলে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জানার চেষ্টা করেন তিনি। নিজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়েও ভাবেন। হামজা বুঝতে পারেন মধ্যপ্রাচ্যে ‘অন্যায়’ যুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের রাস্তায় মিছিল করেন তিনি। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য হামজা নিজেই জানিয়েছেন।
২০০৫ সালে হামজা ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোয় রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। ওই সময় তিনি স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টিতে (এসএনপি) যোগ দেন। রাজনৈতিক দলটির সাবেক নেতা অ্যালেক্স সালমন্ডের যুদ্ধবিরোধী একটি বক্তব্য শুনে তিনি এসএনপিতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
হামজা ইউসেফের রসবোধ প্রবল। এ কারণে তিনি খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। মানুষ সহজে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এমনটা বলেছেন গ্লাসগোর অধিকারকর্মী আকতার খান। হামজা ও আকতার একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, ফুটবল খেলেছেন। তাঁরা দুজন যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ইসলামিক রিলিফে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও কাজ করেছেন।
অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীতিতে সাফল্য পেতে শুরু করেন হামজা। ২০০৭ সালে স্কটল্যান্ডে ক্ষমতায় আসে এসএনপি। তখন বশির আহমেদের সঙ্গে কাজ করতেন হামজা। স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ বা এশীয় বংশোদ্ভূত সদস্য ছিলেন বশির। তিনি ’৬০-এর দশকে পাকিস্তান থেকে স্কটল্যান্ডে গিয়েছিলেন। তখন বাস চালাতেন। হামজাকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন তিনি।
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে বশিরের মৃত্যুর পর হামজাকে নিজের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেন অ্যালেক্স সালমন্ড। তাঁর সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেন হামজা। ২০১১ সালে স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। শপথ নেন ইংরেজি ও উর্দু ভাষায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সরকারে পরিবহন, বিচার এবং স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে করোনা মহামারি মোকাবিলা করে সাফল্য দেখিয়েছেন।
হামজা ইউসেফের রসবোধ প্রবল। এ কারণে তিনি খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। মানুষ সহজে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
হামজা তখন পরিবহনমন্ত্রী, লাইসেন্স ছাড়া এক বন্ধুর গাড়ি চালিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। স্কটল্যান্ডের পুলিশ ৩৬৩ ডলার জরিমানা করে। এরপর বিচারমন্ত্রী থাকাকালে বিদ্বেষ ছাড়ানো প্রতিরোধে আইন করতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কে জড়ান তিনি। বাক্স্বাধীনতার কণ্ঠরোধের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকার সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমে। জরুরি চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় লাগা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
বিতর্ক-সমালোচনা পেছনে ফেলে নিজ দলের নেতা হওয়ার পথে অবিচল হেঁটেছেন হামজা। তাঁর রাজনৈতিক জীবন দুই দশকেরও কম সময়ের। ইতিমধ্যে দলের নেতা হয়েছেন। হতে চলেছেন ফার্স্ট মিনিস্টার। প্রচারণায় হামজা নিজেকে স্কটল্যান্ডের ‘প্রথম অধিকারকর্মী’ নেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সব সময় সোচ্চার থাকার অঙ্গীকার তাঁর।
হামজার মতোই অভিবাসী পরিবারের সন্তান রোজা সালিহ। ২০০১ সালে ইরাক থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্কটল্যান্ডে এসেছিলেন তিনি। হামজার দলের একজন কাউন্সিলর রোজা সালিহ। তিনি বলেন, ‘হামজা বরাবর অভিবাসীদের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা মানুষদের মনোভাব, কষ্ট বুঝতে পারেন।’
ইতিহাস গড়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। এবার স্কটল্যান্ডে ইতিহাস গড়ে ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হামজা ইউসেফ। এখন অভিবাসী এই দুই রাজনীতিকের হাত ধরে যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের রাজনৈতিক ঐক্য কোন পথে যায়—সেটাই দেখার বিষয়।
আরেকটি বিষয়ে হামজার অবস্থান সুস্পষ্ট। তা হলো—স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন, ‘স্কটল্যান্ডের জনগণের স্বাধীনতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
স্বাধীনতার প্রশ্নে ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে গণভোট হয়েছিল। তখন স্বাধীনতার বিপক্ষে ৫৫ শতাংশ আর পক্ষে ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এর দুই বছর পর ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভোটে অধিকাংশ স্কটিশ ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। তার পরও তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে ইইউ ছাড়তে হয়। ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ৫৮ শতাংশ স্কটিশ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। চলতি মাসে তা ৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
হামজা তাঁর পূর্বসূরি নিকোলা স্টার্জেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। নিকোলা নিজেও স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে সোচ্চার। এসএনপির নেতা নির্বাচনে এই স্বাধীনতার প্রশ্নে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার পক্ষে থাকা হামজা শেষ হাসি হেসেছেন। নির্বাচিত হয়ে হামজা বলেছেন, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য তাঁর ‘প্রবল আবেগ’ রয়েছে।
এর আগে ইতিহাস গড়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ঋষি সুনাক। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সামাজিক বিভক্তি এবং করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই রাজনীতিক। স্কটল্যান্ডে এবার ইতিহাস গড়ে ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার। অভিবাসী এই দুই রাজনীতিক ঋষি সুনাক ও হামজা ইউসেফের হাত ধরে যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের রাজনৈতিক ঐক্য কোন পথে যায়—সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আল-জাজিরা, রয়টার্স, দ্য ডন ও বিবিসি অবলম্বনে।