ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের দুই বছরে ন্যাটোর ঐক্য কতটা মজবুত

সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (ডানে) ও ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ। কিয়েভ, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের দুই বছর পূর্ণ হলো আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি। এ অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মস্কোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো অনেকটাই নিজেদের ঐক্য ধরে রেখেছে।

ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে এ জোটের পরিধি বেড়েছে এবং সম্ভবত, শিগগিরই সুইডেনও এর সদস্য হতে চলেছে।

পশ্চিমের সরকারগুলোর মধ্যে এমন একটি অভিন্ন ধারণা রয়েছে যে ইউক্রেনে রাশিয়ার জয় আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা বদলে দিতে পারে; যার খেসারত দিতে হবে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থকেই।

তবু ন্যাটো জোটের মধ্যে বিভক্তি রয়েই গেছে।

ন্যাটোর সদস্য ও বাল্টিক সাগর তীরের তিনটি দেশ (এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া) কিয়েভকে ইউরোপের আরও জোরালো সমর্থন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। জোটের অন্য কয়েকটি সদস্য, যেমন হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারে তাদের সংশয় প্রকাশ করেছে।  

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা নিয়ে ন্যাটোর ঐক্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে গত বছর নেদারল্যান্ডস ও স্লোভাকিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল।  

গত নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছে গার্ট ওয়াইল্ডার্সের কট্টর ডানপন্থী দল ‘পার্টি ফর ফ্রিডম’। কিয়েভের প্রতি আমস্টারডামের সামরিক সমর্থন বন্ধের পক্ষে নির্বাচনের আগে প্রচার চালায় দলটি।

এর দুই মাস আগে সেপ্টেম্বরে স্লোভাকিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচনে অন্য সবার চেয়ে বেশি ২২.৯ শতাংশ ভোট পায় রবার্ট ফিকোর দল স্লোভাক স্যোশাল ডেমোক্রেসি (এসএমইআর)। দলটিকে ক্রেমলিনপন্থী মনে করা হয়।

তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, দেশ দুটির নির্বাচনের ফলাফল ন্যাটোর সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সম্ভবত দুর্বল করবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ফরেন পলিসি ইন ফোকাস’-এর পরিচালক জন ফিফার আল-জাজিরাকে বলেন, ‘দেশগুলোর এই নেতারা ইউরোপের কিছু রীতিনীতির তোয়াক্কা করেন না। ফলে নির্বাচনের এ ফলাফল কমবেশি উদ্বেগের।’

ন্যাটোর সদস্য ও বাল্টিক সাগর তীরের তিনটি দেশ (এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া) কিয়েভকে ইউরোপের আরও জোরালো সমর্থন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। জোটের অন্য কয়েকটি সদস্য, যেমন হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারে তাদের সংশয় প্রকাশ করেছে।  

অবশ্য নির্বাচনের এ ফলাফলকে ন্যাটোর ঐক্যে পরিবর্তন আনার মতো কোনো প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা হিসেবে দেখেন না জন ফিফার।

জন ফিফার বলেন, ‘হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের মতো যথেষ্ট  সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেদারল্যান্ডসের নির্বাচনে ওয়াইল্ডার্স পাননি। এতে দেশটির আগের পররাষ্ট্রনীতি, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বা দেশের জনমত সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করতে পারবেন না তিনি।’

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্তে ইউরেশিয়া অঞ্চলে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপ ও ইউরেশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ম্যাথু ব্রাইজা। তিনিও মনে করেন, কিয়েভের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সংহতিতে নির্বাচনের এসব ফলাফল প্রভাব ফেলবে না।

‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে সম্প্রতি এককভাবে হাঙ্গেরি ব্রাসেলস থেকে ইউক্রেনে বড় অঙ্কের অতিরিক্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান আটকে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তবে এ জোট ভিক্টর অরবানের চেষ্টা সফল হতে দেয়নি’, বলেন ব্রাইজা। তিনি আরও বলেন, ‘এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী এক বা একাধিক নেতার চেয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইইউ ও ন্যাটো বেশি শক্তিশালী।’  

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্প্রতি এককভাবে হাঙ্গেরি ব্রাসেলস থেকে ইউক্রেনে বড় অঙ্কের অতিরিক্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান আটকে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তবে এ জোট ভিক্টর অরবানের চেষ্টা সফল হতে দেয়নি।
ম্যাথু ব্রাইজা, ইউরোপ ও ইউরেশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

উপরন্তু, স্লোভাকিয়ায় ক্রেমলিন-সমর্থক রবার্ট ফিকোর নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেও এখন পর্যন্ত মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর ঐক্য ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো পদক্ষেপে যায়নি ব্রাতিস্লাভা।

আবার, ‘অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসি (এআইইএস)’-এর রিসার্চ ফেলো ক্রিস্টফ শোয়ার্জ বলেন, ‘পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর ফলাফল বার্লিন, প্যারিস, ওয়ারশ—এই তিনের সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত এবং সার্বিকভাবে ন্যাটোকে শক্তিশালী করেছে।’

পশ্চিমা দেশে যুদ্ধের ক্লান্তি

যাহোক, দুই বছর ধরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ক্লান্তি পশ্চিমা দেশগুলোর কারও কারও মধ্যে পেয়ে বসেছে।

ক্রিস্টফ শোয়ার্জ বলেন, ‘ইউক্রেনকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে চলা পশ্চিমা দেশগুলোর এ ক্লান্তি কাটানোর সেরা ওষুধ হলো, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের সত্যিকারের অর্জন ও বিজয়। আর এটি মুঠোয় আনতে পশ্চিমাদের ইউক্রেনকে আরও অনেক সামরিক সহায়তা দিয়ে যেতে হবে।’

শোয়ার্জ আরও বলেন, ‘তবে বাস্তবে ইউক্রেনের অর্জন ও জয়ের দেখা যত দীর্ঘায়িত হবে, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর আসন্ন নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী-বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রভাব তত বাড়াবে, এমনকি নির্বাচনে তারা জিততে পারে। স্বাভাবিকভাবে ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের সমর্থন কমানোর উদ্যোগ জোরালো হবে।’

এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাবিরোধী আখ্যান ছড়াতে রাশিয়ার অপতথ্য প্রচারের কথিত সক্ষমতাও প্রভাব বিস্তার করার মতো একটি বিষয়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (বাঁয়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবিটি ইউক্রেনে সর্বাত্মক রুশ হামলা শুরুর আগে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে এলিসি প্রাসাদে তোলা
ফাইল ছবি: এপি
আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে অনিশ্চয়তা

ইউক্রেনকে প্রশিক্ষণের বাইরে ন্যাটোর দেওয়া সমর্থন যতটা না বাস্তবিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এমন রাজনৈতিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ন্যাটোর একেকটি সদস্যদেশের সমর্থন।

যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ইউক্রেনের ভবিষ্যতের ওপর কতটুক প্রভাব ফেলবে, তা এখনই নিরূপণ করাটা কঠিন।  

ম্যাথু ব্রাইজা বলেন, ‘ইউক্রেনকে সমর্থন প্রদান এবং দেশটির সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে রাশিয়ার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ন্যাটোর ঐক্য নিয়ে বলতে হয়, আপাতদৃষ্টিতে এটি এমন একটি বিষয়ে পরিণত হতে চলেছে, যার সবটাই নভেম্বরে বাইডেন ও ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’

ইউনিভার্সিটি অব আইসল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক সিলজা বারা আর ওমারসডোট্টির বলেন, তিনি মনে করেন যে, ‘ন্যাটোর ঐক্য এখন নিজে থেকেই ঝুঁকির মুখে’।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘ন্যাটোভুক্ত যেসব দেশ জোটের অর্থ জোগাতে পারবে না, তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চাই না—সম্প্রতি ট্রাম্পের করা এমন মন্তব্য খুবই আগ্রাসী।’ তিনি বলেন, ‘অতীতেও নিশ্চয়ই আমরা তাঁকে এ ইঙ্গিত দিতে দেখেছি, ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে যারা রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতম, সেসব দেশ জোটের কম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।’

ইউক্রেন ও ন্যাটো নিয়ে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।  

জন ফিফার বলেন, ‘ট্রান্সআটলান্টিক জোট ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবে ঝুঁকিতে। বাইডেন একে গুরুত্ব দেন ও ট্রাম্প অবজ্ঞা করেন। ট্রাম্প নিজ মিত্রদেশ হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস ও ইতালিকে নিয়ে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অধীন একটি ট্রান্সআটলান্টিক জোটের সম্প্রসারণ দেখতে চান।’

ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে এআইইএস-এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা উলফগ্যাং পুশজাই বলেন, এখন ওয়াশিংটন যদি কিয়েভকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেয়, তবে ইউরোপের দেশগুলো এ ঘাটতি মেটাতে পারবে না। কেননা, তাদের প্রয়োজনীয় সামরিক, গোয়েন্দা সুবিধা ও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা নেই।

‘এর ফলাফল হলো, ইউক্রেনকে প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধবিরতি চাইতে হবে অথবা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং তাতে তাকে হারতে হবে। এর উভয়টি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও রাশিয়াকে গৌরবোজ্জ্বল জয় এনে দেবে’, বলেন উলফগ্যাং পুশজাই। তিনি আরও বলেন, ‘এটি যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের জন্য সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ভূকৌশলগত প্রভাব ডেকে আনবে, যা নিশ্চিতভাবে তাদের স্বার্থানুকূলে নয়।’

আরও পড়ুন