রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি ২০২৬ সালে থামতে যাচ্ছে

জাপোরিঝঝিয়াতে রাশিয়ার বিমান হামলায় বিধ্বস্ত একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেনছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

কিয়েভের সোফিয়া স্কয়ারে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ক্রিসমাস ট্রি দাঁড়িয়ে আছে। সেখানকার পাথুরে পথ ধরে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউক্রেনীয় সেনা কর্মকর্তা ভাসিলি আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন, রুশ সেনারা ইউক্রেনীয়দের ভয়ে আতঙ্কিত।

আল-জাজিরাকে ভাসিলি বলেন, ‘আমি তাদের পরিখায় লাফ দিয়ে ঢুকেছি। তারা সত্যিই আমাদের ভয় পায়।’

তবে ভাসিলি মনে করেন, রুশ সেনারা ভয় পাওয়ার অর্থ এই নয়, ইউক্রেন একতরফাভাবে যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। কারণ, রাশিয়ার সেনাসংখ্যা বেশি, অর্থনীতি শক্তিশালী এবং যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থভান্ডার অনেক বড়। অন্যদিকে ইউক্রেন এখনো জনবল ও অস্ত্রের দিক থেকে পিছিয়ে।

ভাসিলি বলেন, ‘আমি যখন ৮০০ মিটার দূরে শত্রুকে দেখে রেডিওতে চিৎকার করে বলেছিলাম যে আমি একটি ট্যাংক দেখছি, সেটির অবস্থানও জানাই। কিন্তু ওপাশ থেকে বলা হয়, “একটু অপেক্ষা করো”। তখন বুঝে যাই, ওটাতে আঘাত করার মতো আমাদের কাছে কিছুই নেই।’

কিয়েভভিত্তিক পেন্টা থিঙ্কট্যাংকের প্রধান ভলোদিমির ফেসেনকোর মতে, ইউক্রেনকে হয়তো হোয়াইট হাউসের দাবি মেনে দোনেৎস্ক অঞ্চলের কিয়েভ-নিয়ন্ত্রিত অংশ ছেড়ে দিতে হবে। বিনিময়ে রাশিয়া পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের তিনটি অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। আর তা না হলে যুদ্ধ ২০২৭ সাল পর্যন্ত গড়াতে পারে।

যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানকালে গোলার শেলের তীব্র সংকটের প্রসঙ্গ টেনে ভাসিলি এ কথা বলেন। ২০২৩ সালে স্থলমাইন বিস্ফোরণে নিজের বাঁ পা হারানোর আগপর্যন্ত ভাসিলি সম্মুখলড়াইয়ে ছিলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলেও ভাসিলি এখনো সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন। তবে যুদ্ধকালীন বিধি মেনে নিজের নামের শেষ অংশ প্রকাশ না করার জন্য আল–জাজিরাকে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার আশা করা যায় না’

তবে ইউক্রেনের এক জেনারেল মনে করেন, চলমান যুদ্ধেবিরতি টানাটাই একমাত্র বাস্তবসম্মত অর্জন হতে পারে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ যুদ্ধের পাঁচ বছর পূর্ণ হবে।

ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের সাবেক উপপ্রধান ইহর রোমানেঙ্কো আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এ ধরনের আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ (রাশিয়া) থাকলে, কেউই যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আশা করতে পারে না।’

রোমানেঙ্কো আরও বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ইউক্রেনের (সোভিয়েত-পরবর্তী) ১৯৯১ সালের নির্ধারিত সীমানার ভেতরে থাকা সব ভূখণ্ড মুক্ত করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।’

রোমানেঙ্কো মনে করেন, মস্কো যদি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে, তাহলে কিয়েভকে যুদ্ধক্ষেত্রেই রাশিয়ার বাহিনীকে ঠেকাতে হবে। এর জন্য ইউক্রেনকে বড় পরিসরে নিজের সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে।

ইউক্রেন বাহিনীর সাবেক উপপ্রধান বলেন, কোনো ছাড় না দিয়ে কিয়েভকে ‘ন্যায্যভাবে’ সেনা সমাবেশ ঘটাতে হবে, দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন চাহিদাগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং আরও কঠোর সামরিক আইন প্রণয়ন করতে হবে।

রোমানেঙ্কো বলেন, চলতি বছর ইউক্রেনের সামরিক-শিল্প খাতের কর্তৃপক্ষ সশস্ত্র বাহিনীর মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত জোগান দিতে পেরেছে। বাকি ৬০ শতাংশ সরবরাহ করছে পশ্চিমা মিত্ররা। রোমানেঙ্কোর মতে, এই সহায়তা হতে হবে ‘দ্রুত ও কার্যকরী’।

ইউক্রেনীয় সেনারা রুশ সেনাদের নিশানা করতে ব্যবহার করার জন্য একটি ড্রোন নিয়ে ভূগর্ভস্থ ঘাঁটি থেকে বের হচ্ছেন
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

আরেক বিশ্লেষক বলেন, ২০২৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের একটি সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হতে পারে। রাশিয়া যদি যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হতে না পারে এবং বুঝতে পারে যে কিয়েভ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ হজম করতে সক্ষম, তখন তারা (মস্কো) শান্তিচুক্তিতে রাজি হতে পারে।

কিয়েভভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান পেন্টার প্রধান ভলোদিমির ফেসেনকো আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সবকিছুই নির্ভর করবে ক্রেমলিন এবং ভ্লাদিমির পুতিনের (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট) ব্যক্তিগত সম্মতি জানানোর প্রস্তুতির ওপর।’

ফেসেনকো বলেন, যদি আগামী বছর মস্কোর কাছে যুদ্ধের ‘অচলাবস্থা’ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তাহলে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আশা করা যেতে পারে।

ফেসেনকোর মতে, পুতিন রাজি হলেও উভয় পক্ষের শান্তি প্রস্তাবগুলো নিয়ে ঐকমত্য হতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে।

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ইউক্রেনকে হয়তো হোয়াইট হাউসের দাবি মেনে দোনেৎস্ক অঞ্চলের কিয়েভ-নিয়ন্ত্রিত অংশ ছেড়ে দিতে হবে। বিনিময়ে রাশিয়া পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের তিনটি অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। আর তা না হলে যুদ্ধ ২০২৭ সাল পর্যন্ত গড়াতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের একটি সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হতে পারে। রাশিয়া যদি যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হতে না পারে এবং বুঝতে পারে যে কিয়েভ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ হজম করতে সক্ষম, তখন তারা (মস্কো) শান্তিচুক্তিতে রাজি হতে পারে।

যুদ্ধ থামবে কি না, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে।

কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ইহার তিশকেভিচ বলেন, ২০২৬ সালে ‘পশ্চিমা জোটের’ ধারণাই বদলে যাবে। ওয়াশিংটন তার ‘বিশ্বপুলিশ’ ভূমিকা থেকে সরে যাবে এবং বাকি বিশ্বের ওপর পশ্চিমাদের আধিপত্য শেষ হবে।

তিশকেভিচের মতে, বিশ্বে এবং এশিয়ায় চীন তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। কিন্তু দেশটি এখনো পুরোপুরিভাবে ওয়াশিংটনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না। এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইনকেও দুর্বল করবে এবং ইউক্রেনের অবস্থানকে প্রভাবিত করবে।

ইহার তিশকেভিচ বলেন, ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে খারাপ হবে যদি পরিস্থিতি ১৯৩৯ সালের ফিনল্যান্ড পরিস্থিতির মতো হয়। ১৯৩৯ সালে ফিনল্যান্ড-সোভিয়েত যুদ্ধে মস্কো একটি প্রদেশের পুনর্দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সোভিয়েত বাহিনী তখন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমন অবস্থায় ১৯৪১ সালে জার্মানির নাৎসিরা সোভিয়েত ইউনিয়নে হামলা চালায়। তবু মস্কো ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে ১০ ভাগের ১ ভাগ ভূখণ্ড নিয়ে নিয়েছিল এবং হেলসিংকিকে তা স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

তিশকেভিচ আরেকটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা বলেছেন। সেটি হলো ‘জর্জিয়ান’ পরিস্থিতি, যা ২০০৮ সালে রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের সময় দেখা গিয়েছিল। তখন মস্কো ছোট জর্জিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করে এবং সাউথ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া নামের দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

ইউক্রেনের জন্য জর্জিয়ান পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মানে দাঁড়াবে, দখল করা অঞ্চলগুলোর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তবে কিয়েভ সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকারও করবে না।

এ দুটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি ছাড়াও আরেকটি তৃতীয় ‘অন্তর্বর্তী’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও মনে করছেন তিশকেভিচ। আর সেটি হলো যুদ্ধ স্থগিত থাকবে এবং আলোচনা চলতে থাকবে।

তবে জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিনের মতে, শুধু একটি পরিস্থিতিতেই যুদ্ধ থামতে পারে। আর সেটা হলো ইউক্রেনকে দক্ষিণ-পূর্ব দোনেৎস্ক অঞ্চলের বাকি এক-পঞ্চমাংশ এলাকা থেকে সরিয়ে দিতে হবে অথবা স্বেচ্ছায় তাদের সরে যেতে হবে।

মিত্রোখিনের মতে, পাশাপাশি ইউক্রেনকে জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের ৯০ শতাংশ এবং দিনিপ্রোপেত্রভস্কের ১৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা স্বীকার করে নিতে হবে। এসব অংশ এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে আছে।

‘দোনেৎস্কই ছিল আমাদের সমস্যার মূল’

জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিন বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে চাপে ফেলার যে কৌশল নিয়েছে, তা ‘দুর্বল’। কারণ, অনেক দেশই সেগুলো এড়িয়ে মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যে আগ্রহী। এতে ক্রেমলিনের হাতে অন্তত আরও দুই বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ রয়েছে।

বিপরীতে ইউক্রেনের প্রতিরোধ করার সক্ষমতা থাকলেও তাদের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভীরু’ সরকার পর্যাপ্ত জনবল জোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

মিত্রোখিনের মতে, পশ্চিমা মধ্যস্থতাকারীরা রাশিয়াকে থামাতে না পারায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জায়গা থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী ধীরে ধীরে পিছু হটছে।

মিত্রোখিন আল-জাজিরাকে বলেন, ‘তবে এমন সম্ভাবনা আছে যে ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন হয় জেলেনস্কিকে দোনেৎস্ক ছেড়ে দিতে বাধ্য করবে, নয়তো যুদ্ধকালীন (প্রেসিডেন্ট) নির্বাচনের আয়োজন করে ইউক্রেনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাবে।’

অনেক সাধারণ ইউক্রেনীয় নাগরিক যুদ্ধ, রাশিয়ার গোলাবর্ষণ, বিদ্যুৎ–বিভ্রাট এবং অর্থনৈতিক মন্দায় ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন।

৬৩ বছর বয়সী সাবেক অর্থনীতিবিদ তারাস তিমোশচুক আল-জাজিরাকে বলেন, ‘দোনেৎস্কই ছিল আমাদের সব সমস্যার উৎস। রাশিয়া ওটা নিক, আর পুনর্গঠনে কোটি কোটি ডলার খরচ করুক।’

তিমোশচুক ২০১৪ সালে দোনেৎস্ক ও পার্শ্ববর্তী লুহানস্কে রুশপন্থীদের বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনে এ কথা বলেন।

তিমোশচুক বলেন, ‘আমি চাই, পাখির ডাক শুনে আমার ঘুম ভাঙুক। রুশ ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে নয়।’