ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতা করা গেরাসিমভেই এখন আস্থা পুতিনের

রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চিফ অব দ্য জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ কমান্ডার হিসেবে মাত্র তিন মাস দায়িত্ব পালন করেছেন জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন। এই অল্প সময়েই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে তছনছ করে দিয়েছেন ইউক্রেনের বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা। হামলা হয়েছে দেশটির বেসামরিক লোকজনের ওপরও। হঠাৎ করেই তাঁকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধেক্ষেত্রে রাশিয়ার সেনাদের এখন থেকে নেতৃত্ব দেবেন জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ।

৬৭ বছর বয়সী জেনারেল গেরাসিমভকে গত বুধবার নতুন এই পদ দেওয়া হয়। রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফের দায়িত্বও পালন করছেন জ্যেষ্ঠ এই সেনা কর্মকর্তা। এর আগেও রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন তিনি।

গত বছর ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে আংশিক সেনা নিযুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই পদক্ষেপের আওতায় রাশিয়ার কয়েক লাখ নাগরিককে দেশটির সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছিল। সের্গেই সুরোভিকিনের নেতৃত্বে নতুন এই সেনাদের একটি অংশকে ইউক্রেন যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। তবে তাঁদের সফলভাবে কাজে লাগাতে পারেননি তিনি।

তবে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর কমান্ডার হলেও শুরুর দিকে নাকি এই যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন জেনারেল গেরাসিমভ। অভিযোগ রয়েছে, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়ে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর সঙ্গে মতবিরোধ ছিল তাঁর। ক্রেমলিনে হাতে গোনা যে কয়েকজন কর্মকর্তা যুদ্ধের পরিকল্পনা এঁটেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন শোইগু। তবে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে মত দেন গেরাসিমভ।

জেনারেল গেরাসিমভের প্রথমের যুদ্ধের বিরোধিতা, পরে আবার মতবদলের বিষয়ে কথা বলছিলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ পাভেল লুজিন। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘গেরাসিমভের আসলে নিজের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালানোর মতো সাহস ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধের পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিলেন।’

এক সময় যুদ্ধের বিপক্ষে মত দেওয়া গেরাসিমভকেই কেন এই যুদ্ধ সামলানোর গুরু দায়িত্ব দেওয়া হলো? জবাব খোঁজার আগে ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাদের অবস্থাটা দেখে নেওয়া যাক। গত কয়েক মাসে ইউক্রেনীয়দের হামলা ও প্রতিরোধের মুখে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি রাশিয়ার। অনেক জায়গায় তাদের পিছু হটতে হয়েছে। ইউক্রেনে রুশ সেনাদের জন্য আরেকটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমাটবাঁধা শীত। তীব্র ঠান্ডায় ইউক্রেনের মাটির ওপর দিয়ে ট্যাংকসহ অন্যান্য সাঁজোয়া যান চালানো রুশ সেনাদের জন্য একপ্রকার দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

জার্মানির ব্রেমেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ নিকোলাই মিত্রোখিনের মতে, কিয়েভ ও পূর্ব ইউক্রেনে নতুন করে আক্রমণ সাজাতে ব্যর্থ হয়েছে মস্কো। এ কারণেই দেশটিতে রুশ কমান্ডার বদলানো হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহকারীরাও সেনাদের হাতে চাহিদামতো অস্ত্র তুলে দিতে পারছেন না। ফলে দেশটির সামরিক কর্মকর্তারা নিয়মিত অস্ত্র কারখানাগুলো পরিদর্শন করছেন এবং সেগুলোর কর্মকর্তাদের একপ্রকার হুমকির মুখে রেখেছেন।

ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের ক্রেমলিনের ভেতরে আরেকটি লড়াই জোরদার হচ্ছে। এই লড়াইটা পুতিনের কাছাকাছি যাওয়ার, অর্থাৎ ক্ষমতার। এই লড়াইয়ে ক্রেমলিনের ভেতরে অনেক পক্ষ গড়ে উঠেছে।  

গত বছর ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে আংশিক সেনা নিযুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই পদক্ষেপের আওতায় রাশিয়ার কয়েক লাখ নাগরিককে দেশটির সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছিল। সের্গেই সুরোভিকিনের নেতৃত্বে নতুন এই সেনাদের একটি অংশকে ইউক্রেন যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। তবে তাঁদের সফলভাবে কাজে লাগাতে পারেননি তিনি।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, নতুন বছর শুরুর আগে রাশিয়া এই নতুন সেনাদের বড় সংখ্যায় প্রাণহানির ঘটনাটি। কিয়েভের দাবি অনুযায়ী, পূর্ব ইউক্রেনের মাকিভকা শহরে হামলা চালিয়ে ৪০০ রুশ সেনাকে হত্যা করেছে তারা। তবে রাশিয়া ওই দাবি নাকচ করে জানায়, ওই হামলায় তাদের ৮৯ জন সেনা নিহত হয়েছেন।

‘ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটা আসলে বড় কোনো বিষয় নয়। এই নেতৃত্ব বদলের ফলে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে ইউক্রেনে বড় কোনো সাফল্য না পেয়ে রাশিয়া বেশ খারাপ অবস্থানে রয়েছে’
ওলেকসি হারান, অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কিয়েভ মহিলা একাডেমি  

কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সি কুশচ মনে করেন, গেরাসিমভের নিয়োগের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন একটি পর্বের সূচনা হতে পারে। নতুন পর্ব বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ইউক্রেনে নতুন করে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু করা অথবা ইউক্রেনের সেনাদের সম্ভাব্য অগ্রগতি ঠেকিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াকে।  

ক্রেমলিনের ভেতরেও লড়াই

এদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের ক্রেমলিনের ভেতরে আরেকটি লড়াই জোরদার হচ্ছে। এই লড়াইটা পুতিনের কাছাকাছি যাওয়ার, অর্থাৎ ক্ষমতার। এই লড়াইয়ে ক্রেমলিনের ভেতরে অনেক পক্ষ গড়ে উঠেছে।  

এমনই একটি পক্ষ ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন। তিনি রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান। গত শতকের আশির দশকে এই মানুষটি ডাকাতি ও প্রতারণার দায়ে সাজা খেটেছিলেন। কারাগারে থাকায় অবশ্য তাঁর একটি সুবিধা হয়েছিল। সেখানে বন্দী থাকা অনেক অপরাধীকেই পরে তিনি ওয়াগনারে যুক্ত করেছিলেন। এমনই একজন সের্গেই মোলোদস্তভ। নিজের মাকে হত্যার দায়ে তাঁকে সাড়ে ১১ বছর কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি পূর্ব ইউক্রেনের সেরভ শহরে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন মোলোদস্তভ।

সের্গেই শোইগু
রয়টার্স ফাইল ছবি

প্রিগোঝিন ওয়াগনার ২০১৪ সালে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ এবং সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ইউক্রেনের সোলেদার শহরে রুশ হামলার নেতৃত্বও ওয়াগনার দিয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রিগোঝিন। তাঁর ভাষ্য, চলতি সপ্তাহে তাঁর বাহিনীর সদস্যরাই একা হাতে দখল করেছে শহরটি। এর একদিন বাদেই মস্কো জানায়, সোলেদারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রুশ বাহিনী।

প্রিগোঝিনের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে পরিচিত চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ। তিনিও যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর অনুগতদের পাঠিয়ে বুক ফুলিয়ে কথা বলেন। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নানা কর্মকাণ্ডের জন্য দুজনকে নিয়েই রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতবিরোধ রয়েছে। এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে সদ্য সাবেক রুশ কমান্ডার সের্গেই সুরোভিকিনও প্রিগোঝিনের কাছের মানুষ। তাই সুরোভিকিনের ক্ষমতা হারানো ও গেরাসিমভ কমান্ডার হওয়া প্রিগোঝিনের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও গেরাসিমভের মধ্যেও পুরোনো দ্বন্দ্ব রয়েছে। ইউক্রেনের সাবেক উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আনাতোলি লোপাতা বলেন, গেরাসিমভ একসময় ছোটখাটো কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। কাজ করেছেন নির্মাণ খাতেও। পরে ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি রাশিয়ার জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় সামলেছেন। অপর দিকে শোইগু ২০১২ সালে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। তাঁর এই নিয়োগে সে সময় শীর্ষ নেতাদের পছন্দ হয়নি বলেই মনে হয়েছিল।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কিয়েভ মহিলা একাডেমির রাজনীতির অধ্যাপক ওলেকসি হারান বলেন, ‘ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটা আসলে বড় কোনো বিষয় নয়। এই নেতৃত্ব বদলের ফলে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে ইউক্রেনে বড় কোনো সাফল্য না পেয়ে রাশিয়া বেশ খারাপ অবস্থানে রয়েছে।’