ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে কীভাবে, ইতিহাস যা বলছে
ইউক্রেন যুদ্ধ অতীতের অনেক যুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে একুশ শতকের নিজস্ব ধরনে। মুঠোফোনের ক্যামেরা আর ড্রোনের মাধ্যমে ধারণ করা ছবিতে বড় বড় সাঁজোয়া যান ও যুদ্ধাস্ত্র দেখা গেলেও গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধের সঙ্গে শেষমেশ এ যুদ্ধের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
১৯৩৯ সালে ফিনল্যান্ডে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তখন সোভিয়েতের নেতা ছিলেন স্তালিন। সে যুদ্ধে সামরিক ক্ষমতা বিবেচনায় তুলনামূলক ছোট দেশ ফিনল্যান্ডের সঙ্গে সোভিয়েত সেনারা রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে আটকা পড়েছিলেন। ইউক্রেন যুদ্ধেও একই পরিস্থিতির মুখে এখন রাশিয়ার সেনারা।
ইউক্রেনে হামলা চালানোর সময় রুশ বাহিনীর ধারণা ছিল, কয়েক দিনের মধ্যে তাদের এ ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শেষ হবে। কিন্তু কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস, এরপর এক বছর পেরিয়ে যুদ্ধ এখন দ্বিতীয় বছরে পা দিয়েছে। চলছে দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী লড়াই। রাশিয়া নতুন করে সেনা নিয়োগ ও ভাড়াটে সেনা পাঠাচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো মিত্র ইউক্রেনকে ট্যাংক দিচ্ছে। আর বসন্তে রুশ বাহিনীর নতুন করে হামলা জোরদারের ইঙ্গিত দিচ্ছেন অনেকে। ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির কয়েক দিন আগে ঝটিকা সফরে কিয়েভে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘রাশিয়া এ যুদ্ধে কখনো জয়ী হবে না, কখনো না।’
যুদ্ধবিষয়ক ইতিহাসবিদ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মার্গারেট ম্যাকমিলান বলছেন, ‘এটা এমন এক যুদ্ধ, যেটা দেখতে হবে আমরা কখনো ভাবিনি।’ ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে এসে এই প্রশ্ন উঠেছে, এর আগের বিভিন্ন যুদ্ধ, বিশেষ করে আধুনিক কালের যুদ্ধ এ যুদ্ধের শেষ নিয়ে কী বার্তা দেয়?
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাঁজোয়া যান নিয়ে রুশ বাহিনী যখন ইউক্রেন সীমান্তে ঢুকে পড়ে, তখনই এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছিল। এটা এমন এক যুদ্ধ, যেখানে পারমাণবিক ক্ষমতাধর ও শীর্ষ জ্বালানি রপ্তানিকারক একটি দেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশে আক্রমণ করেছে। আক্রমণের শিকার দেশটিও বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহব্যবস্থার অন্যতম একটি কেন্দ্র। ফলে এই যুদ্ধ যে দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকে সেটা ভালোভাবেই আঁচ করা যাচ্ছিল।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কিয়েভকে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দিতে শুরু করে। সামরিক এ সহায়তা এখনো অব্যাহত আছে। ইউক্রেনের আত্মরক্ষার জন্য এ সহায়তা জরুরি।
ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেরমি মরিস ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে ইরান–ইরাক যুদ্ধের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেন, গত শতকের আশির দশকে আট বছর ধরে চলা ইরান–ইরাক যুদ্ধের মতো অতীতের যুদ্ধগুলোতেও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে এ রকম বিদেশের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধে বিভিন্ন সময় রাশিয়াকেও ইরানের মতো অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এদিকে ইরাকের অবস্থানের সঙ্গে ইউক্রেনের সাদৃশ্য আছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মতো ইরান ও ইরাকও ছিল প্রতিবেশী। সেই যুদ্ধও হয়েছিল মূলত ভূখণ্ড আর প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিয়ে। পশ্চিমা অস্ত্রে ইরাক সে যুদ্ধে শুরুর দিকে সামরিক দিক থেকে বেশি ক্ষমতাধর ইরানের বিপক্ষে বেশ সাফল্য পায়। তবে এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল ইরাককে। যুদ্ধে অনেক সেনা আত্মঘাতী হামলা চালান। অন্যদিকে ইরানের সেনারা সাঁজোয়া যান নিয়ে ইরাকের সেনাদের লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেন। শত্রুপক্ষের সেনা নিপাত ছিল এর লক্ষ্য।
মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র যে ইরাককে সহায়তা করেছিল তার উল্লেখ করে অধ্যাপক জেরমি মরিস বলেন, ‘সেবারও সেই যুদ্ধকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল ছায়াযুদ্ধ (প্রক্সি ওয়ার)।’ তবে সেই যুদ্ধের সঙ্গে এই যুদ্ধের প্রধান পার্থক্য হলো এবার যুদ্ধ শুরু করেছে রাশিয়া, সেবার যুদ্ধ শুরু করেছিল ইরাক।
পশ্চিমা দেশগুলো অবিরতভাবে কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ করলেও কোন অস্ত্র দেওয়া হবে, এ ব্যাপারে সব সময়ই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তবে এরপরেও পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র একইভাবে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীকে ঠেকানোর মূল চাবিকাঠি। ত্বাত্ত্বিক দিক থেকেও এতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কোন পথে যাবে, তার ওপর পশ্চিমাদের একটা প্রভাব থাকছে। কিয়েভের চাওয়ামতো পশ্চিমারা আরও দ্রুত অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়াকে বোঝাতে চাইবে তারা এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না।
ম্যাকমিলান বলেন, প্রকৃতপক্ষে কখনো কখনো প্রকাশ্য সংঘাত অবসানে এবং যুদ্ধরত পক্ষকে আলোচনায় আনতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাইরের চাপ।
১৯৯৯ সালে সার্বিয়ায় ন্যাটোর বোমা হামলার উল্লেখ করে ম্যাকমিলান বলেন, ‘কসোভোর বিরুদ্ধে সার্বিয়ার যুদ্ধ শেষ হয়েছিল কারণ বাইরের শক্তিগুলো এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। নর্দান আয়ারল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ শেষ হয় বাইরের শক্তির অনেক চাপের কারণে (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র) এবং এতে শান্তির জন্য একটি কাঠামোও দাঁড়িয়েছিল।
তবে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি এতটা সরল নয়। এখানকার হিসাব–নিকাশ অন্য রকম। বাইরের শক্তি চাপ দিলেই যুদ্ধ বন্ধ হবে, বিষয়টা এমনও নয়।
ইরান ও সার্বিয়ার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। কিন্তু রাশিয়ার আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র। এ ছাড়া রাশিয়া নিজেরাই অনেক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে। এ ছাড়াও অনেক রিজার্ভ সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম আছে। রাশিয়া এই যুদ্ধ বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করছেন জেরমি মরিস।
যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার সমাজ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে এসবের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলো সামলে উঠেছে রাশিয়া। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া এতই দুর্বল হয়ে যাবে না যে এই যুদ্ধ চালাতে পারবে না তারা। গত বছর রাশিয়ার অর্থনীতি ২ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে, যা ধারণার চেয়ে অনেক কম।
মরিস বলছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসে হস্তক্ষেপের কারণে রাশিয়া একঘরে হয়ে ছিল। ফলে ইউক্রেনে হামলা করলে আরও একঘরে হওয়ার বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল মস্কো। একঘরে হলে রুশদের জীবনযাত্রার মান হয়তো কমবে কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মতো অবস্থা কখনো হবে না।’
বিশ্লেষকদের মতে, সার্বিয়ার মতো দৃশ্য ইউক্রেনে দেখা যাবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটও কখনো সরাসরি রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধে জড়াবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ‘হাউ ওয়ারস এন্ড’ বইয়ের লেখক ড্যান রিয়েটারের কথায়ও এমন ইঙ্গিতই পাওয়া গেল। তিনি বলেন, ‘ন্যাটোর সঙ্গে তুলনা করলে সার্বিয়া ছিল অনেক দুর্বল। উসকানি ছাড়াই ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।’