বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণে যাঁর চিন্তা অন্তহীন প্রেরণার উৎস

কার্ল মার্ক্সছবি: চ্যাটজিপিটি দিয়ে তৈরি

ইতিহাসে সময় কখনো কখনো মুখর ও চঞ্চল হয়ে ওঠে। তখন খোলনলচে অনেক কিছু বদলাতে শুরু করে। জন্ম হয় নতুন মানুষের। এঁদের মধ্যে দু-একজন থাকেন দুর্লভ, যাঁদের দেখার চোখ, বলার ভঙ্গি বা শোনার ক্ষমতা সবার চেয়ে আলাদা। এসব মননশীল ও গভীর চিন্তাশীল মানুষ প্রচলিত ধ্যানধারণায় মোচড় দেন, নড়েচড়ে বসে সমাজ। তাঁদের মৌলিক চিন্তা সমস্যাকে শনাক্ত করার ও বিশ্লেষণের কাঠামোই আমূল বদলে দেয়। কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স এমনই একজন মনীষী। ৫ মে ছিল তাঁর ২০৭তম জন্মদিন।

তৎকালীন প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের রাইন প্রদেশের ট্রিয়ার শহরে ১৮১৮ সালের ৫ মে এক ইহুদি পরিবারে কার্ল মার্ক্সের জন্ম। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে কার্ল মার্ক্স ছিলেন তৃতীয়। দক্ষিণ জার্মানির এই শহর তখন আজকের মতো এতটা বড় ছিল না। মানে, ইউরোপের কোনো রাজধানী শহর নয়, একটি অপরিচিত প্রাদেশিক শহর থেকেই উঠে এসেছিলেন আধুনিক সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী এই দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও স্বাপ্নিক।

পেশার জন্য পিতার ধর্মান্তর

মা হেনরিয়েট প্রেসবার্গ ছিলেন ডাচ বংশোদ্ভূত একটি রেবাই বা ইহুদি ধর্মগুরু পরিবারের মেয়ে। বাবা হাইনরিশ মার্ক্সের পূর্বপুরুষেরাও রেবাই ছিলেন। তবে তাঁদের অনেকে আলোকিত চিন্তাধারায় (এনলাইটেনমেন্ট) প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভলতেয়ার ও রুশোর মতো দার্শনিকদের প্রশংসা করতেন।

হাইনরিশই প্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁদের পরিবার থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষালাভ করেছিলেন। তিনি পেশাজীবনে আইন ব্যবসা করে ভালোই রোজগার করেছিলেন। আঙুরবাগান থেকেও তাঁদের যথেষ্ট অর্থকড়ি আসত।

মার্ক্সের বাবা হাইনরিশই প্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁদের পরিবার থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষালাভ করেছিলেন। তিনি পেশাজীবনে আইন ব্যবসা করে ভালোই রোজগার করেছিলেন।

একটা সময় ধর্মের কারণে আইন ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছিল। তাই মার্ক্সের জন্মের আগেই ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নিয়েছিলেন হাইনরিশ। তখন প্রুশীয় সাম্রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ লুথারীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন।

মার্ক্সের মা-বাবার কেউ তেমন একটা ধর্ম পালন করতেন না। বাবা হাইনরিশ দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ও ভলতেয়ারের গুণগ্রাহী ছিলেন। হাইনরিশকে ধ্রুপদি উদারপন্থী (ক্ল্যাসিক্যাল লিবারেল) বলা যায়। একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের ভয় উপেক্ষা করে তিনি সংবিধান ও সংস্কারের দাবিতে প্রুশিয়াতে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

পড়াশোনা ও দর্শনের সূত্রপাত

মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে ট্রিয়ার জিমনেশিয়াম বা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৭ বছর বয়সে স্নাতক হন। এই স্কুলে অনেক উদারপন্থী শিক্ষক ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন কার্ল মার্ক্স। কিন্তু বাবার পীড়াপীড়িতে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁর বাবা মনে করতেন, মার্ক্স পণ্ডিত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না। তা ছাড়া আইন পড়লে সংসারজীবনে অনটন থাকবে না বলেও মনে করতেন তিনি।

কিছুদিনের মধ্যে কার্ল মার্ক্স বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান হুমবল্ডত বিশ্ববিদ্যালয়) বদলি নিয়ে চলে আসেন। কারও কারও মতে, বাবা জোর করে তাঁকে বার্লিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কেউ বলেন, হবু বউ জেনি ভন ওয়েস্টফালেনের পরামর্শে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন।

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় মার্ক্সের চিন্তাজগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। এখানে তরুণ হেগেলিয়ানরা দর্শন, ধর্ম, রাষ্ট্র, নৈতিকতা, ইতিহাস, ভাববাদ, অধিবিদ্যা, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে প্রাণবন্ত তর্কবিতর্ক করতেন।

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় মার্ক্সের চিন্তাজগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। এখানে তিনি তরুণ হেগেলিয়ানদের সাক্ষাৎ পান। সবাই দর্শন নিয়ে মেতে আছেন। শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা বিষয়ে তর্ক করছেন। দর্শন, ধর্ম, রাষ্ট্র, নৈতিকতা, ইতিহাস, ভাববাদ, অধিবিদ্যা, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা নন্দনতত্ত্ব—কী নেই তাঁদের আলোচনায়! হেগেলের শিষ্যরা ‘ডক্টর ক্লাব’ নামে একটি সংগঠনও খুলেছিলেন। লুডভিগ ফয়েরবাখ ও ব্রুনো বাউয়ার মতো ব্যক্তিরা ছিলেন এর প্রধান হর্তাকর্তা।

কার্ল মার্ক্সের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে। জার্মানির ট্রিয়ার শহরে, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
ছবি: রয়টার্স

১৮৪১ সালে কার্ল মার্ক্স পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‌‘দ্য ডিফারেন্স বিটুইন দ্য ডেমোক্রিটিয়ান অ্যান্ড এপিকিউরিয়ান ফিলোসফি অব নেচার’। এতে তিনি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস ও এপিকিউরাসের আণবিক তত্ত্বের (অ্যাটমিক থিওরি) তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখান, এপিকিউরাসের দর্শনে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও নৈতিকতা-বিষয়ক ব্যাখ্যা ডেমোক্রিটাসের যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বেশি মানবিক ও স্বাধীনতামুখী।

মার্ক্স কিন্তু পিএইচডি অভিসন্দর্ভ বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব জেনা-তে জমা দিয়েছিলেন। কারণ, তরুণ হেগেলিয়ানের মধ্যে অগ্রগামী হওয়ায় তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন।

সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ

কৈশোর থেকেই কার্ল মার্ক্স গ্রিক ট্র্যাজেডি, অ্যারিস্টোফেনিসের কমেডি, হোমারের মহাকাব্য, শেক্‌সপিয়ারের নাটক ও গ্যেটের রচনার অনুরাগী ছিলেন। জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের সঙ্গে প্যারিসে তাঁর দেখা ও বন্ধুত্ব হয়েছিল। তবে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মার্ক্সকে অতিরোমান্টিক ও বাস্তবতাবর্জিত মনে করতেন হাইনে। গ্যেটের মতো হাইনেও বিপ্লবের বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন।

সাহিত্য মার্ক্সের কাছে বিনোদনের খোরাক বা অবসর কাটানোর বিষয় ছিল না। দার্শনিক চেতনার অংশ হিসেবে তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। তরুণ বয়সে তিনি কিছু কবিতা, একটি নাটক ও একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। ১৮৩৭ সালে প্রেমিকা জেনিকে নিয়ে কিছু কবিতা লিখেছিলেন, যা রোমান্টিক ও অস্তিত্ববাদী ধাঁচের।

কার্ল মার্ক্সের পরবর্তী সময়ের জটিল বিষয়ের লেখালেখিতে তরুণ বয়সের সাহিত্যচর্চার ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর কথা বলা যায়। পুস্তিকাটির শুরুর লাইনগুলোই ছিল থরে থরে রূপকে সাজানো ছন্দময় কবিতার মতো: ‘আ স্পেক্টর ইজ হান্টিং ইউরোপ—দ্য স্পেক্টর অব কমিউনিজম। অল দ্য পাওয়ার্স অব ওল্ড ইউরোপ হ্যাভ এনটার্ড ইন্টু আ হোলি অ্যালায়েন্স টু এক্সরসাইজ দিস স্পেক্টর: পোপ অ্যান্ড জার, মেটারনিখ অ্যান্ড গিজো, ফ্রেঞ্চ র‍্যাডিক্যালস অ্যান্ড জার্মান পুলিশ-স্পাইস।’

কার্ল মার্ক্স। ১৮৭৫ সালে
ছবি: মার্ক্স-এঙ্গেলস ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে

পরিবার

কার্ল মার্ক্সের বিবাহিত জীবন ছিল ভালোবাসা, সংগ্রাম ও দারিদ্র্যের এক সংমিশ্রণ। বয়সে চার বছরের বড় জেনি ফন ভেস্টফ্যালেনের সঙ্গে মার্ক্সের শৈশব থেকেই পরিচয়। জেনির বাবা লুডভিগ ফন ভেস্টফ্যালেন ছিলেন মার্ক্সের বাবার বন্ধু এবং প্রগতিশীল মননের মানুষ। জেনিরা নব্য অভিজাত হলেও মার্ক্সের পরিবারের বনেদিপনা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, জ্ঞানের প্রতি মার্ক্সের আগ্রহ জেনি ও তাঁর বাবাকে মুগ্ধ করেছিল।

শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডা ও মেলামেশা করতে করতে মার্ক্স ও জেনি দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। ১৮৩৬ সালে তাঁদের বাগ্‌দান হয়। বিয়ে হয়েছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৮৪৩ সালের ১৯ জুন।

এই দম্পতির মোট সাত সন্তান জন্ম নিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মাত্র তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তাঁরা হলেন জেনি ক্যারোলিন, লরা ক্যারোলিন ও ইলেনর ক্যারোলিন। জেনি ও মার্ক্স দারিদ্র্য, রাজনৈতিক নির্বাসন এবং ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির মধ্যেও সন্তানদের শিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তুলেছিলেন। লরা ও ইলেনর পরে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ইলেনর মার্ক্স যুক্তরাজ্যে শ্রমিক আন্দোলনের পরিচিতি সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন।

জেনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিনি মঞ্চ সমালোচক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। মার্ক্সকে লেখালেখির কাজে সহায়তা করতেন। তিনি মার্ক্সের শুধু জীবনসঙ্গী ছিলেন না, মার্ক্সের বুদ্ধিবৃত্তিক সহচর এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের এক বিশ্বস্ত সহযাত্রী ছিলেন।

জেনি-মার্ক্সের জীবনে আর্থিক অনটন, প্যারিস-লন্ডন নির্বাসন, সন্তান হারানোর বেদনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা অটুট ছিল। মার্ক্সের ব্যক্তিজীবনের এই অধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের মানবিক পটভূমি তৈরিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

কার্ল মার্ক্স (বাঁয়ে) ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ভাস্কর্যের সামনে তিন ব্যক্তি। চীনের সাংহাইয়ের একটি উদ্যানে, ৩ মে ২০১৮
ছবি: রয়টার্স

সাংবাদিকতা

কার্ল মার্ক্সের বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিপ্লবী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা ছিল তাঁর চিন্তাভাবনা প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। ১৮৪২ সালে জার্মানির কোলনে তিনি ‘রাইনিশছে সাইটুং’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। যোগ্যতাবলে দ্রুত তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক হয়েছিলেন। এখানে তিনি প্রুশিয়ার শাসনব্যবস্থা, সেন্সরশিপ, সামাজিক বৈষম্য, কৃষক সমস্যা ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে লেখেন। তাঁর ক্ষুরধার সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে ১৮৪৩ সালে সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়।

প্যারিসে ১৮৪৪ সালে আর্নল্ড রুগের সঙ্গে মিলে ডয়েচ-ফ্রানৎসয়িশে ইয়ারবুখার বের করা শুরু করেন কার্ল মার্ক্স। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই বছরই ওই পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। এই পত্রিকায় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস লিখেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে মার্ক্স-এঙ্গেলসের বিখ্যাত বন্ধুত্ব শুরু হয়, যা আজীবন টিকে ছিল। ওই বছরই প্যারিস থেকে জার্মান অভিবাসীদের জন্য প্রকাশিত হয় ‘ফরভেয়ার্টস’। এতে মার্ক্সসসহ অন্য বিপ্লবীরা বেশ কড়া কড়া সমালোচনা লিখতেন।

ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য, ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক পার্থক্যগুলোর মধ্যে একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল, যা মার্ক্সের সরলরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।

মার্ক্স লন্ডনে বসে নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে দীর্ঘ সময়ে লিখেছেন। ১৮৫২ থেকে ১৮৬২ সালের মধ্যে এই পত্রিকায় তিনি ৫০০টির মতো নিবন্ধ লেখেন। এতে তিনি উপনিবেশবাদ, ভারতীয় অর্থনীতি, ব্রিটিশ রাজনীতি, মার্কিন গৃহযুদ্ধ ও ইউরোপীয় বিপ্লব নিয়ে বিশ্লেষণ লিখেছেন। তাঁর এসব লেখায় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংমিশ্রণ ঘটত। যেখানে দর্শনের সঙ্গে সংগ্রামী বাস্তবতা মিলেমিশে যেত।

ডেইলি ট্রিবিউনে লেখার জন্য তিনি নিয়মিত সম্মানী পেতেন এবং এটাই ছিল তাঁর পরিবারের আয়ের মূল উৎস, যা ছিল যথেষ্ট অপ্রতুল। তাই তাঁকে প্রায় সময় ঋণ করতে হতো। খুব অর্থকষ্টে ছিলেন কার্ল মার্ক্স।

ভারত নিয়ে মন্তব্য

মার্ক্স নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে ভারত নিয়ে ১৮৫৩ সালে ‘দ্য ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ নামের একটি বিশ্লেষণ লেখেন। এতে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতিকারক প্রভাব তুলে ধরেন। তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশরা ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজের মধ্যে ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন আনলেও তাদের শাসন ভারতীয় সমাজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও এনেছে। যেমন খনিজ সম্পদ ও বাণিজ্যের আধুনিকীকরণ, রেলওয়েসহ অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন।

মার্ক্সের মতে, ভারতীয় সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো বা ঐতিহাসিকভাবে তেমন একটি পরিবর্তন হয়নি। এই সমাজ স্ট্যাটিক বা স্থবির ছিল। কারণ, এখানে কোনো শ্রেণিসংগ্রাম বা সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায়নি।

জেনি-মার্ক্সের জীবনে আর্থিক অনটন, প্যারিস-লন্ডন নির্বাসন, সন্তান হারানোর বেদনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা অটুট ছিল। মার্ক্সের ব্যক্তিজীবন তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের মানবিক পটভূমি তৈরিতে সহায়তা করেছিল।

সমালোচকদের মতে, ভারত নিয়ে মার্ক্সের এই ধারণা ভুল ছিল। তিনি ভারতীয় সমাজের ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেননি। তিনি একে শুধু একটি ‘স্ট্যাটিক’ শোষিত সমাজ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে সংস্কৃতি, ধর্ম ও সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিককে উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারতীয় সমাজে সামাজিক আন্দোলন, ধর্মের পালাবদল এবং ঐতিহাসিক উত্থান-পতন মার্ক্সের আলোচনায় উপেক্ষিত ছিল।

ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মার্ক্স ভারতের সমাজকে ইউরোপীয় কাঠামোতে বিচার করেছেন, যা ঐতিহাসিক বিকাশের দিকগুলো ধরতে ব্যর্থ। ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য, ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক পার্থক্যগুলোর মধ্যে একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল, যা মার্ক্সের সরলরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।

কার্ল মার্ক্সের স্ত্রী জেনি ফন ভেস্টফ্যালেন। ১৮৩২ সালে
ছবি: মার্ক্স-এঙ্গেলস ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

মার্ক্স তাত্ত্বিক চিন্তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার ওপর জোর দিতেন, যা প্রাক্সিস হিসেবে পরিচিত। তাঁর এই ধারণা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ও এঙ্গেলস মনে করতেন, সমাজ পরিবর্তন কেবল তাত্ত্বিক আলোচনা বা গবেষণার মাধ্যমে নয়, বরং ক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ড ও বিপ্লবী সংগ্রামের মাধ্যমেই সম্ভব।

মার্ক্স ইউরোপীয় প্রগতিশীল আন্দোলন ও কমিউনিস্ট লিগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনগুলোতে কাজ করতে গিয়ে তিনি কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো তৈরি করেন, যা শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক একতা ও বিপ্লবের আহ্বান জানায়।

কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো

১৮৪৮ সালের শুরুর দিকে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে মিলে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো লেখেন কার্ল মার্ক্স। মূল খসড়াটি মার্ক্সই লিখেছিলেন। এঙ্গেলস গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও কাঠামোগত বিষয়ে অবদান রেখেছিলেন।

এই পুস্তিকা ছিল কমিউনিস্ট লিগ নামের একটি গোপন বিপ্লবী সংগঠনের প্রকাশিত রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র। এর উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক শ্রেণি বা সর্বহারাদের মুক্তির লক্ষ্যে একটি স্পষ্ট, বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর কর্মসূচি তুলে ধরা।

মেনিফেস্টোর মূল বার্তা ছিল—এই যাবৎকালের মানবজাতির ইতিহাস মানেই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। সমাজ সর্বদাই শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্বে বিভক্ত এবং পুঁজিবাদী সমাজে এই দ্বন্দ্ব হলো পুঁজিপতি বনাম মজুরের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব।

ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য, ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক পার্থক্যগুলোর মধ্যে একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল, যা মার্ক্সের সরলরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।

মার্ক্স-এঙ্গেলস মনে করতেন, প্রলেতারিয়েত বা নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই ভবিষ্যতে সমাজে বিপ্লব আনবে এবং পুঁজিবাদী শাসনকে উৎখাত করবে।

পুস্তিকাটির প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক আন্দোলনের আদর্শিক ভিত্তি হয়ে ওঠে। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব; চীন, কিউবা, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে ছোট্ট বইটি গভীর প্রভাব ফেলে। বইটি নানাভাবে আজও প্রাসঙ্গিক।

ডাস ক্যাপিটাল

মার্ক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রমসাধ্য বই ‘ডাস ক্যাপিটাল’। ১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝি বইটি লেখা শুরু করেন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নানা খসড়া, পুনর্লিখন ও গবেষণার মধ্য দিয়ে একে পরিপূর্ণ রূপ দেন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে বইটি লেখার সময়ে তিনি নাওয়াখাওয়া প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন। অভাব-অনটন সত্ত্বেও তিনি গবেষণা চালিয়ে যান। বইটি লিখতে গিয়ে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বইটি লেখা প্রসঙ্গে মার্ক্স কোনো এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘আমি প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে কাটাতাম, অর্থনীতি ও ইতিহাসের অসংখ্য বই ঘেঁটে এই কাজ করেছি।’

ডাস ক্যাপিটাল তিন খণ্ড।  প্রথম খণ্ড (১৮৬৭) মার্ক্সের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়। মূল্য, পণ্য, শ্রমশক্তি, উদ্বৃত্ত মূল্য প্রভৃতি ছিল এর মূল প্রতিপাদ্য। কার্ল মার্ক্সের মৃত্যুর পর ১৮৮৫ সালে দ্বিতীয় ও ১৮৯৪ সালে তৃতীয় খণ্ড সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস।

ডাস ক্যাপিটালে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে শ্রমিকদের কীভাবে শোষণ করা হয়, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে বা শোষণ করে মালিকপক্ষ কীভাবে পুঁজি ক্রমেই বৃদ্ধি করতে থাকে, এই প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে কীভাবে সংকট তৈরি করে, তা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়।

প্রাসঙ্গিকতা

কার্ল মার্ক্স মনে করতেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরেই দ্বন্দ্ব আছে। এই অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কারণে বিকাশের একটা পর্যায়ে গিয়ে এই ব্যবস্থা নিজ থেকে ভেঙে পড়বে। কিন্তু মার্ক্সের মৃত্যুর ১৪২ বছর পরও সেই শোষণমূলক ব্যবস্থা চালু আছে। বলা ভালো, তীব্রতর হয়েছে। ধনী-গরিব বা শ্রেণিবৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে।

পণ্ডিতেরা বলেন, পুঁজিবাদের অবসান হয়নি, শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্নও অধরা। এতে আপাতত মনে হয়, মার্ক্স ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। ব্যাপারটি এত সরল নয়। এই সহজ-সরল সফলতা-ব্যর্থতা, ভালো-মন্দ ইত্যাদির মতো দ্বৈততা দিয়ে মার্ক্সের মতো ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয় বোঝা অসম্ভব।

ডাস ক্যাপিটালে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে শ্রমিকদের কীভাবে শোষণ করা হয়, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে বা শোষণ করে মালিকপক্ষ কীভাবে পুঁজি ক্রমেই বৃদ্ধি করতে থাকে, এই প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে কীভাবে সংকট তৈরি করে, তা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্ক্সের সবচেয়ে বড় অর্জন তিনি আধুনিক অর্থনীতির শোষণমূলক চরিত্রটি উন্মোচিত করেছেন। বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি তা করেছেন, যা আমাদের সময়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থাপন, বিগ-ডেটা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যাগুলো বুঝতে সহায়তা করবে। তাঁদের মতে, মার্ক্সবাদ কোনো প্রশ্নাতীত মতবাদ বা ডগমা নয়, এটা একটি প্রক্রিয়া, যেটা উদ্ভূত শর্ত বা পরিস্থিতির নিরিখে সৃজনশীলভাবে এগিয়ে যায়।

এখন আখেরি জমানার পুঁজিবাদ (লেট ক্যাপিটালিজম) চলছে। এই সময়ে পুঁজি ধীরে ধীরে বস্তুগত (কারখানা, জমি ইত্যাদি) থেকে বিমূর্ত (ডেটা, আর্থিক অংশীদারত্ব, ক্রিপ্টো) রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে। এসব বুঝতে মার্ক্সের তত্ত্ব আমাদের সহায়তা করতে পারে।

চার্লস ডারউইনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল। এতে মার্ক্সের স্বাক্ষর রয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে
ছবি: রয়টার্স

নির্বাসন ও মৃত্যু

নির্বাসন ছিল মার্ক্সের জীবনের নিত্য সঙ্গী। ১৮৪৩ সালে প্রুশিয়া থেকে প্যারিসে যান। কারণ, তাঁর লেখালেখি ও মতাদর্শ সরকার পছন্দ করছিল না। ১৮৪৪ সালে প্যারিসে ডয়েচ-ফ্রানৎসয়িশে ইয়ারবুখার বের করার পরও বিতর্ক ওঠে। ফ্রান্স সরকার তাঁকে ১৮৪৫ সালে প্যারিস ছাড়তে বাধ্য করে। সেখান থেকে তিনি ব্রাসেলসে যান। সেখানে এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের সময় বার্লিনে ফিরে এলেও সেই বিপ্লব ব্যর্থ হলে আবার কোলনে চলে যান। সেখান থেকে বাধ্য হয়ে আবার ব্রাসেলস হয়ে প্যারিসে যান। অবশেষে ১৮৪৯ সালে লন্ডনে স্থায়ীভাবে নির্বাসিত জীবন শুরু করেন।

মার্ক্সের কোনো কোনো জীবনীকার বলেছেন, এঙ্গেলসের পরামর্শেই মার্ক্স রাজনৈতিক অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। আগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখলেও লন্ডনে আসার পর থেকে মার্ক্স মোটাদাগে কেবল রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়েই ডুবে ছিলেন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘ডাস ক্যাপিটাল’ তিনি এই সময়ে লিখেছেন।

কার্ল মার্ক্স ১৮৮৩ সালে ১৪ মার্চ লন্ডনের কেন্টিশ টাউনে মারা যান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। তাঁকে লন্ডনের হাইগেট সমাধিস্থলে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিফলকে লেখা আছে: ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও!’ তাঁর বিখ্যাত ফয়েরবাখের থিসিস থেকে একটি উদ্ধৃতি সেখানে লেখা আছে: ‘দার্শনিকেরা এত দিন দুনিয়াকে শুধু ব্যাখ্যা করেছেন...কিন্তু মূল বিষয় হলো, তা পরিবর্তন করা।’

তথ্যসূত্র:

. হ্যাপি বার্থডে, কার্ল মার্ক্স। ইউ অয়্যার রাইট! নিউইয়র্ক টাইমস

. মার্ক্সিজম অ্যাট মার্ক্স’স টু হান্ড্রেডথ বার্থডে: বিয়ন্ড রাইট অর রং, ইন্টারভেনশন.এনজি

. আ লেটার টু কার্ল মার্ক্স অন হিজ টু হান্ড্রেডথ বার্থডে, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস

. কার্ল মার্ক্স, উইয়ার্ডার দ্যান এভার, নিউইয়র্ক টাইমস

৫. কার্ল মার্ক্স: প্রফেট অব দ্য প্রেজেন্ট

. মার্ক্স প্রেডিক্টেড আওয়ার প্রেজেন্ট ক্রাইসিস—অ্যান্ড পয়েন্টস দ্য ওয়ে আউট, দ্য গার্ডিয়ান

. দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো