রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার জন্য চাপে থাকা ইউক্রেনের সামনে কি বসনিয়ার ভাগ্য

ডেটন চুক্তি বসনিয়াকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। ইউক্রেনের উচিত একই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ শান্তিচুক্তির জন্য চাপ রুখে দেওয়া। ইউক্রেনের ওপর এমন চাপ কীভাবে ঠেকানো যাবে এবং পরিস্থিতি নিয়ে আল-জাজিরায় একটি অভিমত প্রকাশ করেছেন বসনিয়ার লেখক ও সারাজেভো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক হামজা কার্সিচ। তাঁর লেখাটি বাংলা করা হলো:  

ভ্লাদিমির পুতিন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি
রয়টার্স ফাইল ছবি

গত কয়েক মাসে ইউক্রেন অনেক সমালোচককে ভুল প্রমাণ করেছে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, সহজেই ইউক্রেনকে হারিয়ে দেবে রুশ বাহিনী। কিন্তু কিয়েভে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে বিশাল এলাকা রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর এই সাফল্য এবং রুশ বাহিনীর পিছু হটার বিষয়টি কিয়েভের মিত্রদের আরও সহায়তা বাড়ানোর জন্য রাজি করানোর জন্য যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। এর বদলে ইউক্রেনের সরকারের ওপর ক্রেমলিনের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য কিছুটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ জেনারেল মার্ক মিলে বিশেষ করে কূটনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিচ্ছেন। এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি বলছেন, রুশ বাহিনীর দখলে নেওয়া বাকি এলাকা উদ্ধার করতে পারবে না ইউক্রেন। মার্ক মিলের কথাকে অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সব সদস্য প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন না। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা আলোচনায় বসতে রাজি থাকার বিষয়টি প্রকাশে চাপ বোধ করছেন।

মার্ক মিলে বলেন, ‘বসনিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে ইউক্রেনের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটতে দেখে আমি সতর্কধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে, ত্রুটিপূর্ণ শান্তিচুক্তি করে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে রাখার মতো বসনিয়ার ভাগ্য বরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। অবশ্য বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার সঙ্গে ইউক্রেনের পুরোপুরি তুলনা করা চলে না। ১৯৯২ সালে যখন বসনিয়া আক্রান্ত হয়, তখন জাতিসংঘ দেশটির ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে বসনিয়া নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারেনি। অনেক এলাকা শত্রুর হস্তগত হয় এবং গণহত্যা থামানো সম্ভব হয়নি।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসূরি ইউরোপীয় সম্প্রদায় ও জাতিসংঘ এমন কূটনীতিকদের পাঠিয়েছিল, যাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে বিভক্তির নীতি অনুসরণ করেন। বসনিয়ার মানুষ যখন পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের আশা করেছিলেন, তখন ব্রিটিশ মধ্যস্থতাকারী ডেভিড ওয়েন বসনিয়ানদের স্বপ্ন না দেখার পরামর্শ দেন।

পক্ষান্তরে রাশিয়ার আক্রমণের শুরু থেকে পশ্চিমাদের কূটনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পেয়ে আসছে ইউক্রেন। পশ্চিমা সামরিক সহায়তায় কিয়েভ শুধু রুশ পরিকল্পনা ভেস্তেই দেয়নি, পাশাপাশি সফলভাবে পাল্টা আক্রমণ চালাতে সক্ষম হচ্ছে।

বসনিয়ার বাহিনী ১৯৯৫ সালে যখন পাল্টা আক্রমণ শুরু করে, তখনই পশ্চিমাদের চাপে তাদের থামতে হয় এবং শান্তিচুক্তিতে বসতে বাধ্য হয় সরকার। একইভাবে ইউক্রেন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুটা ভালো অবস্থানে যেতে শুরু করেছে, তখন তাদেরও অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বলা হচ্ছে।  

বসনিয়ার ক্ষেত্রে আলোচনার জন্য যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা সারাজেভোকে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে যায়। সারাজেভোর সেনাদের আরও এলাকা মুক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে সার্বিয়া ও সার্ব বিদ্রোহী বাহিনী আলোচনায় বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল, যেমনটি পাওয়ার মতো অবস্থানে তারা ছিল না।

রাশিয়া এখনো ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এ ছাড়া খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার কিছু অঞ্চলও রুশ বাহিনীর দখলে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন বসনিয়ার মতো পরিস্থিতিতে নিজেকে দেখতে পারে।

পশ্চিমা চাপ অব্যাহত থাকলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেটবেগোভিচের মতোই কঠিন কিছু বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। ১৯৯৫ সালে ডেটন শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী দলের নেতৃত্বদাতা মার্কিন কূটনীতিক রিচার্ড হলব্রুক  ইজেটবেগোভিচের সামনে এমনই কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন।

হলব্রুক প্রেসিডেন্ট ইজেটবেগোভিচকে বলেছিলেন, ‘আপনি কি চান যে আমরা একটি একক বসনিয়ান রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করি, যেখানে অপরিহার্যভাবে একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে, নাকি আপনি বসনিয়াকে বিভক্ত হতে দিতে চান, যেখানে ছোট দেশে আপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে?’

বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট দেশটির অখণ্ডতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সার্ব বিদ্রোহীদের আবার মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য রিপাবলিকা শ্রপস্কা নামে স্বায়ত্তশাসিত একটি রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের বসনিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভেটো প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর ফলে বসনিয়ার ঐক্যের বিরোধী শক্তিগুলোকে বসনিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যেকোনো নির্বাহী বা আইন প্রণয়নকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। বসনিয়ার পার্লামেন্টের সভা এবং আইন অনুমোদন থেকে শুরু করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত যেকোনো কিছু যেকোনো সময়ে আটকে দিতে পারে এই শক্তি। এই ভেটো ক্ষমতার অর্থ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে দেশের কার্যকারিতা এবং এর স্থিতিশীলতা নষ্টের ক্ষমতা তুলে দেওয়া।

এখন জেলেনস্কি যদি শান্তি আলোচনায় রাজি হন, তাঁকেও একই ধরনের কিছু বেছে নিতে বলা হবে— রাশিয়ার দখল করা অঞ্চল তাদের ছেড়ে দেওয়া অথবা স্বতন্ত্র অঞ্চল গঠন, যার শাসনকর্তারা ক্রেমলিনের প্রতি অনুগত থাকবেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট অবশ্য ক্রিমিয়াসহ রুশ বাহিনীর দখলে নেওয়া সব এলাকা মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি যদি ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিষয়ে ছাড় দেন, তাহলে দেশে তাঁর অবস্থান পড়ে যাবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়বে।

এতে কেবল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া অঞ্চলই নয়, ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সব অঞ্চল নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে। তাতে ভবিষ্যতে আক্রমণ বা দেশের অংশবিশেষকে বহিঃশক্তির নিজেদের অঞ্চল দাবি করা থেকে ইউক্রেন নিরাপদ থাকবে, এমন নিশ্চয়তা কখনোই থাকবে না।

জেলেনস্কিকে যদি দেশটির পূর্বাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন দিতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তিনিও রিপাবলিকা শ্রপস্কার মতো কোনো সত্তা প্রতিষ্ঠার ঝুঁকিতে পড়ে যাবেন। এতে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের ইউক্রেনের শাসনক্ষমতায় নাক গলানোর সুযোগ তৈরি হবে। শ্রপস্কার যেমন ভেটো ক্ষমতা আছে, তেমনি ক্ষমতা পাবে পূর্বাঞ্চল। এতে বসনিয়ার মতো ইউক্রেন অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে দেশটির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও আটকে যাবে।

ইউক্রেন তাই বসনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং একই ভুল এড়াতে পারে। তড়িঘড়ি করে শান্তি আলোচনায় বসার চাপ ঠেকাতে হবে কিয়েভকে। ইউক্রেনের লবিং ও জনসংযোগ বিভাগ ভালো কাজ করছে। তাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তবে যুদ্ধের ক্লান্তিতে পেয়ে বসা পশ্চিমা সমাজের জন্য সেরা জনসংযোগ এবং প্রতিষেধক হলো সামরিক সাফল্য।

যুদ্ধক্ষেত্রের সাফল্য বাড়ানোর জন্য এগোতে হবে ইউক্রেনকে। যদিও যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ণ মুক্তি অর্জন করা সম্ভব নয়, তবে বিশাল এলাকা দখলমুক্ত করে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে জয় পাওয়ার মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে গেলে ইউক্রেন বাড়তি সুবিধা পাবে। পুরোপুরি রুশ সেনা প্রত্যাহার ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার দাবি করতে পারবে।

আলোচনার টেবিলে মীমাংসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধ ক্ষেত্রে কার কী সামরিক পরিস্থিতি। বসনিয়ার ক্ষেত্রে রিপাবলিকা–শ্রপস্কার সীমানা নির্ধারণ করে বসনিয়ার মুসলিম অঞ্চলগুলোতে রাজত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয়। ইউক্রেনে কিয়েভ ও পশ্চিমাদের তা ঘটতে দেওয়া উচিত হবে না।

বসনিয়ার ত্রুটিপূর্ণ শান্তিচুক্তি দেশটিকে অকার্যকর করে তুলেছে এবং এর নিরাপত্তা ও উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এটি সহজেই লুফে নিয়েছে রাশিয়া। তারা রিপাবলিকা–শ্রপস্কার নেতৃত্বকে কাজে লাগাচ্ছে। তারা বলকান ও ইউরোপ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। জেলেনস্কি তার পশ্চিমা অংশীদারদের এই নজিরটির কথা মনে করিয়ে দিলে ভালো করবেন। এ ছাড়া তাদের কাছে দ্রুত শান্তি আলোচনার জন্য অযৌক্তিক দাবি না করার আহ্বান জানাতে পারেন।