‘মানব চিড়িয়াখানা’, তিন শহরের ভয়ংকর অতীত

পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের চিড়িয়াখানায় ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মানুষ প্রদর্শন করা হতো
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখন ইউরোপের দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শাসনের দাপট। জার্মানি, পর্তুগাল ও বেলজিয়ামে বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ ধরে এনে রাখা হতো চিড়িয়াখানায়। ইউরোপিয়ানরা বাঘ, ভাল্লুকের সঙ্গে খাঁচায় বন্দী মানুষও দেখতেন খুব মজা করে।

জার্মানির হামবুর্গ, পর্তুগালের লিসবন এবং বেলজিয়ামের ব্রাসেলস—ইউরোপের বিখ্যাত এই তিন শহরে ঘটা করে আয়োজন করা হতো অপুষ্টিতে কাহিল অশ্বেতাঙ্গ মানুষের প্রদর্শনী। কলঙ্কের এই ইতিহাস অবশ্য ইউরোপের সবাই প্রায় ভুলতে বসেছেন। মানুষের এমন বর্ণবাদী ‘এথনোগ্রাফিক এক্সিবিশন’-এর কথা জার্মানি, পর্তুগাল ও বেলজিয়ামের বেশির ভাগ মানুষ জানেন না। আবার যাঁরা জানেন, তাঁরা তা স্বীকার করেন না।

ইউরোপের তখনকার শাসকেরা মানবতার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করা এসব প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন মূলত ‘ইউরোপীয় সভ্যতার’ আধিপত্য জাহির করতে। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৫ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হয়ে এই প্রবণতা চলেছে ১৯ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত।

জার্মানিতে ‘মানব চিড়িয়াখানা’

জার্মানিতে উপনিবেশ থেকে মানুষ অপহরণ করে এনে চিড়িয়াখানায় ঢুকিয়ে রাখাকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করেছিলেন ব্যবসায়ী কার্ল হাগেনবেক। তাঁর কোম্পানি জার্মানির হামবুর্গ শহরের চিড়িয়াখানায় প্রথম মানুষের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ১৮৭৪ সালে। সেই থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত হামবুর্গ চিড়িয়াখানায় ‘মানুষ প্রদর্শনী’ ছিল দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ এক আকর্ষণ। কার্ল হাগেনবেক আর বেঁচে নেই। তবে হামবুর্গ চিড়িয়াখানা এখনো আছে। চিড়িয়াখানাটির পরিচালনার দায়িত্বে আছে কার্ল হাগেনবেকের হাগেনবেক কোম্পানি।

সম্প্রতি জার্মানির সংবাদমাধ্যম এনডিআরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউরোপে ‘মানব চিড়িয়াখানার’ অতীত নিয়ে কথা বলেছেন ইতিহাসবিদ ইয়্যুর্গেন সিমার। তিনি বলেছেন, হামবুর্গ চিড়িয়াখানার মতো ইউরোপের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় পরিকল্পনা করেই মানুষ রাখা হতো। মানবতার প্রতি এমন অপমানজনক অতীতের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ইয়্যুর্গেন সিমার।

তবে মানব চিড়িয়াখানা চালু করা ক্লাউস হাবেরবেকের সন্তান কার্ল মনে করেন, ওই আমলের শিল্প এমনই ছিল। শিল্পের দাবি পূরণ করতেই বাঘ, ভাল্লুকের মতো মানুষও দেখানো হতো চিড়িয়াখানায়।

পর্তুগালে মানুষ যখন ‘চিড়িয়া’...

পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় মানুষের প্রদর্শনী করা হতো। তখন পর্তুগাল শাসন করছিলেন স্বৈরাচারী শাসক আন্তনিও ডি অলিভিয়েরা সালাসার। তাঁর উদ্যোগে ১৯৪০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সিবিশনে খাঁচায় বন্দী মানুষ দেখেছেন কয়েক হাজার মানুষ।

ব্রাসেলসের ‘কালো অধ্যায়’

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ১৯৫৮ সালের ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের মতো বড় আয়োজনেও পশু-পাখির মতো প্রদর্শিত হয়েছে মানুষ।

ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট রেসিজমের (ইএনএআর) এক প্রত্নতাত্ত্বিক ব্রাসেলসের ওই কালো অধ্যায়ের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁর মতে, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের ব্যাপক প্রসার এবং মানুষের মধ্যে পর্যটনে আগ্রহ রাতারাতি খুব বেড়ে যাওয়ার কারণে ইউরোপের দেশগুলো ‘মানব চিড়িয়াখানার’ ধারণা থেকে সরে এসেছে।