রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে জার্মানি, কেন অভিযোগ করছে মস্কো

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজছবি: এএফপি

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জার্মান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আলোচনার এক অডিও রেকর্ডিং ফাঁস হয়ে গেছে। এ নিয়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরির পাশাপাশি জার্মান সেনাবাহিনীর যোগাযোগব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে।

রাশিয়া বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যে জড়িত, এই রেকর্ডিং তা প্রমাণ করে।

কী ফাঁস হলো
১ মার্চ রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত আরটি চ্যানেলের প্রধান মার্গারেট সিমোনিয়ান টেলিগ্রামে ৩৮ মিনিটের সেই অডিও রেকর্ড পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেন, জার্মান সেনা কর্মকর্তারা ক্রিমিয়ায় সম্ভাব্য হামলা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

মার্গারেট বলেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানির বিমানবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইঙ্গো গেরহার্টজ ও উচ্চপদস্থ তিন কর্মকর্তার মধ্যে এই কথোপকথন হয়েছিল।

ইউক্রেন বাহিনীর জার্মানির তৈরি শক্তিশালী টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভাব্য ব্যবহার এবং ব্যবহার করলে তার সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে—রেকর্ডিংয়ে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শোনা গেছে।

কিয়েভ দীর্ঘদিন ধরে জার্মানির কাছে টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্র চেয়ে আসছে। এটি ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বের লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম।

তবে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এই ক্ষেপণান্ত্র পাঠাতে নারাজ। তাঁর শঙ্কা, এটি দুই দেশের যুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করবে, যুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়াবে।

কী নিয়ে আলোচনা
রেকর্ডিংয়ে সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ এই তিন কর্মকর্তা টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভাব্য ব্যবহার এবং কতটি ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হতে পারে—সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

আলোচনার একপর্যায়ে টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়ে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়াকে যুক্তকারী কার্চ সেতুটি ধ্বংস করা হবে কি না, তা নিয়ে কথা বলেন তাঁরা। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে।

ওই কর্মকর্তারা আলোচনার সময় ইউক্রেনকে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কথা বলেন। একজন কর্মকর্তা তখন বলেন, যুদ্ধের ময়দানে যুক্তরাজ্যের সৈন্যরা আছে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বলছে, ইউক্রেনে থাকা কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে ও ইউক্রেনের স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা দিতে ‘অল্পসংখ্যক সেনা’ সেখানে রয়েছে। তবে যুদ্ধে সৈন্যরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার এবং এদের লক্ষ্যবস্তু ঠিক করার প্রক্রিয়া ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর নিজেদের বিষয়।  

ইউক্রেনের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ইউক্রেনে ইউরোপের সব গোয়েন্দা বিভাগের উপস্থিতি রয়েছে। তবে তারা মোটেই যুদ্ধ ইউনিট নয়।

সূত্র আরও জানায়, মিত্ররা যখন কিয়েভকে যুদ্ধসরঞ্জাম দেয়, তখন প্রশিক্ষণ ও সেগুলোর ব্যবহারে সহায়তা দিতে ‘বিশেষজ্ঞরা মাঠে থাকে।

কীভাবে ফাঁস হলো
অডিও ও ভিডিও বৈঠকের জন্য জনপ্রিয় পাবলিক প্ল্যাটফর্ম ওয়েবএক্সে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াসের তথ্যমতে, নির্দিষ্ট কিছু বৈঠকের জন্য প্ল্যাটফর্মটি বৈধভাবে সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে। সঙ্গে নেওয়া হয় অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থাও।

পিস্টোরিয়াস বলেন, অংশগ্রহণকারীরা সম্ভবত ভুল নিরাপত্তা সেটিংস ব্যবহার করেছেন অথবা এ ধরনের বৈঠকের জন্য ভুল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে।

জার্মানির বিরোধী রক্ষণশীল নেতা রডেরিখ কিসেওয়েটার বলেন, রুশ কোনো অংশগ্রহণকারীর বৈঠকে সরাসরি যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল। তবে কীভাবে সেটি হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।

রডেরিখ জার্মান সম্প্রচারকেন্দ্র জেডিএফকে বলেন, অন্যান্য আরও কথোপকথন রেকর্ড করে রাখা হতে পারে এবং পরে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করে এমন সুবিধামতো সময়ে সেগুলো ফাঁস করা হতে পারে।

ওলাফ শলৎজের জন্য কী অর্থ বহন করে
এই কেলেঙ্কারি নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। জার্মান চ্যান্সেলর শলৎজ নিজেই এই ঘটনাকে ‘খুবই ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন। এতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সঙ্গে ঐক্যে ফাটল ধরতে পারে।

বিরোধীদলীয় রক্ষণশীল নেতা পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রধান থর্স্টেন ফ্রেই ওয়েল্ট টিভিকে বলেন, কথোপকথনের মধ্যে এ ধরনের আড়িপাতা জার্মানির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।

ওলাফ শলৎজ প্রকাশ্যেই ইউক্রেনকে টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্র দেবেন না বলে ঘোষণা দেন। এখন এই কথোপকথন ওলাফ শলৎজ কী কারণে এমন ঘোষণা দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

ওলাফ যুক্তি দেখিয়েছেন, ইউক্রেনে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ এবং সেগুলো মোতায়েনের বিষয়ে জার্মানি তাদের সমর্থন দিতে পারে না।

তবে ফাঁস হওয়া রেকর্ডিংয়ে জার্মানির সরাসরি সহায়তা ছাড়া টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালনা করা যাবে না কেন—সে বিষয়ে কোনো ধরনের কথা হয়নি।

রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কী
ক্রেমলিন গতকাল সোমবার বলেছে, রেকর্ডিংয়ের কথোপকথনই প্রমাণ করে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, রেকর্ডিংয়ে শোনা গেছে, জার্মানির সশস্ত্র বাহিনী বুন্দেসওয়ের রুশ ভূখণ্ডে হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ও নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করেছে।

বর্তমানের রুশ নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ টেলিগ্রামে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার মস্কোয় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। তবে জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই তলবের বিষয়টি নাকচ করে দেয়। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই এই বৈঠকের পরিকল্পনা হয়েছিল। এতে যোগ দিতেই আমাদের রাষ্ট্রদূত সকালে গিয়েছিল।’

জার্মানি কী বলছে
জার্মান বিশেষজ্ঞদের মতে, রেকর্ডিংয়ে যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার প্রায় সবই এখন রাশিয়া জানে।

জার্মানির পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির প্রধান মারি-অ্যাগনেস স্ট্র্যাক-জিমারম্যান বলেন, মস্কো ইচ্ছাকৃতভাবেই এই রেকর্ডিং ফাঁস করছে, যাতে জার্মানি ইউক্রেনকে টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ না করে।

জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াসও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘পুতিন যে তথ্যযুদ্ধ চালাচ্ছেন, এই কথোপকথন ফাঁস তারই অংশ।’

জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র গতকাল সোমবার রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির যুদ্ধের প্রস্তুতির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘অসম্ভব...এটি রাশিয়ার অপপ্রচার’।

পিস্টোরিয়াস বলেন, এ ঘটনায় অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা–সংক্রান্ত তদন্ত চালানো হতে পারে, তবে এ জন্য কাউকে বরখাস্ত করা হবে না।