পথ শ্বাপদসংকুল। যেকোনো সময় সিংহ বা কোনো হিংস্র প্রাণীর মুখোমুখিও হয়ে যেতে পারেন। রাসেল কুক জানেন না, তখন কী করবেন। জানেন না, উত্তপ্ত মরুভূমি আর মাইলের পর মাইল গহিন অরণ্য পেরোতে কত–শত বাধার মুখে তাঁকে পড়তে হবে। শুধু ইচ্ছা তাঁর অদম্য। এইটুকু সম্বল করে সব বাধা উপেক্ষা করে আফ্রিকা পেরোতে চান তিনি। কিন্তু গাড়ি বা উড়োজাহাজে নয়, দৌড়ে।
যুক্তরাজ্যের নাগরিক রাসেল কুক টগবগে তরুণ। বয়স মাত্র ২৬। তাঁর অভিযান শুরু হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে, সপ্তাহ তিনেক আগে। তাঁর আশা, আগামী বড়দিনের আগেই আফ্রিকার সবচেয়ে উত্তরের দেশ তিউনিসিয়ায় পা রাখবেন। হিসাবে ২৪০ দিন। এ সময়ে তিনি দৌড়ে পাড়ি দেবেন ১৬টি দেশ। ৩৬০টি ম্যারাথন দৌড়ের সমান এই পথ।
আমি একটা ছন্দের মধ্যে আসার চেষ্টা করছি। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাইছি। শরীরের ওপর ছোট ছোট ধকল পড়ছে। তবে আর কয়েকটা সপ্তাহ কাটাতে পারলে, প্রতিদিনই স্বাচ্ছন্দ্যে দৌড়াতে পারব।
রাসেল কুক প্রথম দুই সপ্তাহে দিনে ৫০ কিলোমিটার করে দৌড়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা পেরিয়ে এখন রয়েছেন নামিবিয়ায়। এবার নামিব মরুভূমি জয়ের পালা। এই দীর্ঘ মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার কথা শুনলে অনেকেই আঁতকে উঠবেন। তবে তাঁর কথা আলাদা। এর আগে এমন আরও বেশ কিছু অসাধ্যসাধন তিনি করেছেন। একবার তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর থেকে দৌড়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। আরেকবার ম্যারাথনে দৌড়ের সময় পুরোটা পথ একটি গাড়ি টেনেছিলেন। এসব করে তাঁর নাম হয়েছে ‘কঠিনতম মানুষ’।
আফ্রিকা অভিযান নিয়ে ভয় পাচ্ছেন না বলে সিএনএনকে জানালেন কুক। তাঁর জবানিতে, ‘যতক্ষণ মনে করবেন আপনি ঠিক কাজটি করছেন, ততক্ষণ দুশ্চিন্তা করার কোনো মানেই নেই। পথে সবকিছু আমরা চিন্তাভাবনা করে সাজিয়ে নিতে পারি। বাধা জয় করার বা কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারি। তবে এসব কিছু নিয়ে অতটা ভাবি না। দিনের কাজ দিনে সামলান। ঘুম থেকে উঠুন। আবার পরের দিনের কাজ সামলান।’
যেভাবে দৌড়ের শুরু
কুকের কিশোর–জীবন অতটা সরল ছিল না। জীবিকার টানে নামতে হয়েছিল কাজে। একপর্যায়ে ডুবে গিয়েছিলেন হতাশায়। চলে গিয়েছিলেন বিপথে। সপ্তাহান্তের অবকাশে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠতেন মদ্যপান আর জুয়ায়। এভাবেই চলছিল। যুক্তরাজ্যের ব্রাইটন শহরের নৈশক্লাবের একটি ঘটনায় তাঁর জীবন বদলে যায়।
সেদিন রাত আনুমানিক তিনটা। নৈশক্লাবে বসে কুকের মনে হলো, এভাবে জীবন কাটানোর কোনো মানেই হয় না। নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। সেই রাতেই তিনি দৌড়ে গেলেন বাড়িতে। প্রায় তিন ঘণ্টায় ১২ মাইল দৌড়ে ফিরলেন বাড়ি। এরপর এক বন্ধুর পরামর্শে পরপর কয়েকটি ম্যারাথনে অংশ নেন। কুক বললেন, ‘দীর্ঘ সময়ের পর সেই প্রথমবারের মতো নিজের ওপর ভরসা খুঁজে পেলাম।’
কুকের জীবনে শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। ভ্রমণের জন্য অর্থ জমাতে শুরু করলেন। গেলেন আফ্রিকায়। দেখা হলো ইতালির এক সাইক্লিস্টের সঙ্গে। তিনি সাইকেলে করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তাঁর কাছে পাওয়া প্রেরণাই কুককে দৌড়ে আফ্রিকা পেরোনোর সাহস জুগিয়েছে।
পথে যত বাধা
এত বড় যাত্রায় তো বাধা আসবেই। শুরুতেই দেখা দিল ভিসা–জটিলতা। নিজের দেশ থেকে তাঁর দলের গাড়িটি আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়ার সময়ও বাধা আসে। সব সামলে গত এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে পা রাখেন তাঁরা। এরপরও প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রতিকূলতা তাঁদের থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন কুক। দক্ষিণ আফ্রিকায় একা একা দৌড়ানোর সময় দুজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। মনে হলো ডাকাত। এ তো গেল মানুষের কথা। যদি কখনো হিংস্র প্রাণীর সামনে পড়ে যান? হাসতে হাসতে কুক বললেন, ‘সিংহের সামনে পড়ে গেলে, সত্যি বলছি, কাপড় নোংরা করে ফেলব।’
আরেকটি বড় সমস্যা গরম। দৌড়াতে গিয়ে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে পায়ে। এর জেরে আফ্রিকা পাড়ি দেওয়ার অভিযান থেকেও ছিটকে পড়ে যেতে হতে পারে। তবে ইতিবাচক ধারণা নিয়েই কুক চলেন। তিনি বললেন, ‘আমি একটা ছন্দের মধ্যে আসার চেষ্টা করছি। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাইছি। শরীরের ওপর ছোট ছোট ধকল পড়ছে। তবে আর কয়েকটা সপ্তাহ কাটাতে পারলে, প্রতিদিনই স্বাচ্ছন্দ্যে দৌড়াতে পারব।’
সবকিছু সামলে নেওয়ার ব্যাপারে নিজের ওপর আস্থা থাকলেও একটি বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা কমছে না কুকের। টাকা আসবে কোত্থেকে? আপাতত পরিচিত একজনের দেওয়া অর্থে খরচ সামলাচ্ছেন। সামনের দিনগুলোতে আরও অর্থ জোগাড় করতে এই অভিযানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিচ্ছেন। সেসব ধীরে ধীরে ইন্টারনেটে ছড়াচ্ছে। ইউটিউবে দেওয়া একটা ভিডিও ৫০ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে।
কুকের সামনে এখনো সাত মাসের পথ। হয়তো আরও বাধা আছে। তবে তাঁর বিশ্বাস, সব সামলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন তিনি। কুক বললেন, ‘যখন বয়স হবে, আমি রকিং চেয়ারে বসে থাকব। পাশে নাতি-নাতনিরা দৌড়াদৌড়ি করবে। পুরোনো দিনের কিছু গল্প আমার সঙ্গে থাকবে। মন্দ হবে না।’
কুক বলছিলেন, যতক্ষণ দেহে হৃৎস্পন্দন আছে, ততক্ষণ তিনি রাস্তায় থাকবেন। দৌড়াতে না পারলে হাঁটবেন। সেটাও যদি না পারেন, হামাগুড়ি দেবেন।