রাশিয়া কি ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বেরোনোর পথ খুঁজছে

ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তির জন্য পুতিনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানফাইল ছবি: এএফপি

যুদ্ধের আট মাস পর এসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অবস্থান কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু জায়গায় ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণে পিছু হটেছে রুশ বাহিনী। এর মধ্যে গত শুক্রবার পাঁচ মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু।

যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি গত শুক্রবার বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় পুতিনকে অনেক বেশি নমনীয় মনে হয়েছে। সমঝোতা আলোচনার বিষয়েও তাঁর অবস্থান আগের তুলনায় উন্মুক্ত মনে হয়েছে। তাই সম্ভাব্য আলোচনার মাধ্যমে চলমান যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে আশাবাদী এরদোয়ান। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আশা ছাড়ছি না।’

এরদোয়ানের এমন কথার যৌক্তিকতা পাওয়া যায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের বক্তব্যেও। তিনি গত শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুরু থেকেই পুতিন আলোচনার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন, সেই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে এমনকি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর আগে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।’

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে স্থল, আকাশ ও নৌপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন রাশিয়ার সেনারা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

দিমিত্রি পেসকভ আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যস্থতাকারীরা যখন একটি প্রস্তাব নিয়ে মতৈক্যের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, সে সময় সমঝোতার বিষয়ে প্রস্তুত ছিলেন পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্টের সেই অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত আছে। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের অবস্থান বদলে গেছে। ইউক্রেনের আইন এখন সমঝোতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুদ্ধ বন্ধ করতে রাশিয়ার সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে ওয়াশিংটন। তবে এই মুহূর্তে অর্থবহ সংলাপের জন্য রাশিয়ার আগ্রহী হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এর আগে চলতি মাসের শুরুতে রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এক সাক্ষাৎকার বলেছিলেন, যুদ্ধের ইতি টানতে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তুরস্কের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী তারা। কিন্তু যুদ্ধের আট মাস পার হতে চললেও সমঝোতার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো প্রস্তাব পায়নি রাশিয়া।

যোগাযোগ অব্যাহত রাখা

গত মে মাসের পর শুক্রবার প্রথম টেলিফোনে কথা হয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের মধ্যে। ফোনালাপের পর দুই দেশই পৃথক বিবৃতি দিয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যস্থতাকারীরা যখন একটি প্রস্তাব নিয়ে মতৈক্যের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, সে সময় সমঝোতার বিষয়ে প্রস্তুত ছিলেন পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্টের সেই অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের অবস্থান বদলে গেছে। ইউক্রেনের আইন এখন সমঝোতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিমিত্রি পেসকভ, রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তর ক্রেমলিনের মুখপাত্র

বিবৃতিতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, দুই প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাসংকট নিয়ে কথা বলেছেন। আলোচনায় ইউক্রেন পরিস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। অন্যদিকে পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অস্টিন।

আরও পড়ুন
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে এটি দ্বিতীয় ফোনালাপ ছিল। এর আগে গত ১৩ মে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। ওই সময় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আহ্বান জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। সেই টেলিফোন আলাপে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তিনি।

ওই সময়ে রুশ বাহিনী কিয়েভ অঞ্চল থেকে সরে এলেও পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস ও উত্তর-পূর্বের খারকিভে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলেও সংহত অবস্থান তৈরি হয়েছিল তাদের।

আরও পড়ুন

তবে যুদ্ধের ছয় মাসের মাথায় প্রায় ফ্রন্টেই রাশিয়ার বাহিনীকে চাপের মুখে ফেলে ইউক্রেন। পশ্চিমা দেশগুলোর দেওয়া আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দক্ষিণের খেরসন অঞ্চলে রাজধানী খেরসন শহর পুনর্দখলের লড়াইয়ে এগিয়েছে। তারা রাশিয়া বাহিনীর কাছ থেকে খেরসন পুনরায় দখল করতে পারলে এই যুদ্ধে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হবে। কারণ, ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে এই খেরসন দখলে নিয়েছিলেন রাশিয়ার সেনারা। ইউক্রেনের বাহিনীর আক্রমণের মুখে ওই অঞ্চল থেকে প্রায় ৬০ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সেখানে রাশিয়ার বসানো প্রশাসন। বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার এই উদ্যোগের পেছনে সেনাদের জন্য দুর্গ গড়ে তোলার সুযোগ তৈরির বিষয়টিও রয়েছে।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি যখন এই, তখন আলোচনা-সমঝোতার সম্ভাবনাও ডালপালা মেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত শুক্রবার বলেছেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করতে রাশিয়ার সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে ওয়াশিংটন। তবে এই মুহূর্তে অর্থবহ সংলাপের জন্য রাশিয়ার আগ্রহী হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’

সম্প্রতি ইউক্রেনের শহরগুলোতে জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। গত মঙ্গলবার এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘রুশ হামলায় দেশের জ্বালানি অবকাঠামোর তিন ভাগের এক ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই এবারের শীতে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যেতে পারে।’

আরও পড়ুন

নতুন মারিউপোল?

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, খেরসন শহর ঘিরে আগামী দিনগুলোয় জোরালো লড়াই হতে পারে। বিশ্লেষক মিখাইলো সামুস বলেন, রাশিয়ার সেনাদের এ শহরটি অনেক আগেই খালি করা উচিত ছিল। বর্তমানে শহরটিতে লাখো বাসিন্দা আছে। সে কারণে ইউক্রেনের সেনাদের শহরটিতে সর্বাত্মক আক্রমণ চালানোর আশঙ্কা কম বলে মনে করেন তিনি।

ফ্রান্সের প্যারিসের সরবোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পিয়েরে গ্রেসার বলেন, ইউক্রেনের বাহিনী এর আগে শহরের বাইরে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছিল। কিন্তু তারা যদি এবার খেরসনের শহরতলিতে ঢোকার চেষ্টা করে, তাহলে সেটা বিপজ্জনক হতে পারে।

এ অবস্থায় পিয়েরে গ্রেসার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, শহর এলাকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। প্রথমে আক্রমণ করলে সেই পক্ষে প্রাণহানির শঙ্কা বেশি। এমনটা হলে খেরসন এলাকাটি ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে নতুন মারিউপোলে পরিণত হতে পারে।

আরও পড়ুন