ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন চায় অনেক দেশ

রাজতন্ত্রের বিলোপ চেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দুজন। সম্প্রতি লন্ডনেছবি: সংগৃহীত

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুক্তরাজ্য ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর রাজার দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁর বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস। তিনি এখন এসব দেশের রাজা ও রাষ্ট্রপ্রধান। রানির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এসব দেশের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সম্পর্কের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন থাকবে বা আদৌ থাকবে কি না। কারণ, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে এসব দেশের সম্পর্ক মোটেও সহজ-সরল নয়, বরং বেশ জটিল। রানির মৃত্যু এসব দেশে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিতর্ককে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

কট্টর রিপাবলিকান হলেও প্রয়াত রানির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলের চোখে জল আসতে দেখা যায়। তবে টার্নবুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার ওপর গণভোট হয়তো শিগগিরই হবে না। তবে একদিন গণভোট হতেই হবে, এটা অবধারিত।

অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ বলেছেন, এখন রানির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়। কিন্তু কোনো এক সময় গণভোট হবে।

চলতি বছর রানির সিংহাসন আরোহণের ৭০ বছর পূর্তির এক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ায় ‘প্রজাতন্ত্রবিষয়ক মন্ত্রী’ নিয়োগ করা হয়, যাঁর দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়াকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা এবং একজন অস্ট্রেলিয়ানকে রাষ্ট্রপ্রধান করাসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখা। ধারণা করা হয়, ২০২৪ বা ২০২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এ নিয়ে গণভোট হতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথই ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় যোগসূত্র। সেই রানিই এখন প্রয়াত। ফলে ব্রিটিশ রাজপরিবার নিয়ে মানুষের মনোভাব বদলে যাবে।

শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, অনেকগুলো দেশ, যারা একদা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অংশ ছিল, এসব দেশের অনেক মানুষ ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে আর তাদের রাষ্ট্রের শীর্ষে দেখতে চাইছে না। কিছুদিন আগে বার্বাডোজ ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

এ ছাড়া বহুকাল ধরেই প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো আরও কিছু দেশের অনেক মানুষ।

বার্বাডোজ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এটা এক ‘সামষ্টিক প্রভাব’ সৃষ্টি করতে পারে। এর অর্থ হলো আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আরও অনেক দেশ ব্রিটেনের রাজাকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশগুলো। এমনকি খোদ ব্রিটেনেও রাজতন্ত্রের বিলোপের পক্ষের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যুক্তরাজ্যে সর্বশেষ জনমত জরিপে, ৬১ শতাংশ মানুষ এখনো রাজতন্ত্র বহাল রাখার সমর্থক, অন্যদিকে ২৪ শতাংশ চান একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক দেশ ঔপনিবেশিক শাসন ও রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন নির্বাচিত ব্যক্তিকে গ্রহণ করে। উপমহাদেশে ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হলেও প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় ১৯৫০ সালে, পাকিস্তান হয় ১৯৫৬ সালে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ১৯৭০-এর দশকে গায়ানা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো এবং ডমিনিকা তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে ব্রিটেনের রানিকে সরিয়ে দেয়। ফিজি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় ১৯৮৭ সালে, মরিশাস ১৯৯২ সালে।

ক্যারিবিয়ান দেশ জ্যামাইকা এ বছরের শুরুতে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে তারা ঔপনিবেশিক সম্পর্ক ছেদ করে বার্বাডোজের মতোই একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হতে চায়। সাম্প্রতিক জরিপগুলোয় দেখা যাচ্ছে, জ্যামাইকার অর্ধেক মানুষ এখন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। রানির মৃত্যু হয়তো এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডেও এমন ভাবনাচিন্তা বাড়ছে। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, তিনি মনে করেন, তাঁর জীবদ্দশাতেই নিউজিল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে। তবে তাঁর দেশ এখনই এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে না।