বিতর্কের কেন্দ্রে নিষিদ্ধ গুচ্ছবোমা

শুধু মানবাধিকার সংগঠনগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে না, অস্বস্তিতে পড়েছে ওয়াশিংটনের মিত্ররাও।

গুচ্ছবোমার একটি অংশ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বেহাত হওয়া ভূখণ্ড উদ্ধারে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। পাশাপাশি আরও পশ্চিমা অস্ত্র ও ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করে যাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন আলোচনায় ইউক্রেনকে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা, তথা গুচ্ছবোমা সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত। শুধু মানবাধিকার সংগঠনগুলোই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে না, অস্বস্তিতে পড়েছে খোদ ওয়াশিংটনের মিত্ররাও।

বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকি থাকায় বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশ গুচ্ছবোমা নিষিদ্ধ করেছে। একসঙ্গে অনেক ছোট বোমা ছোড়া হয় বলে এতে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নির্বিচার মানুষ নিহত হন। এ ছাড়া অবিস্ফোরিত থাকার হার বেশি বলে পরবর্তী সময়ও এ বোমায় বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গত শুক্রবার জানানো হয়, তারা ইউক্রেনকে গুচ্ছবোমা দেবে। তবে অন্য দেশের ভূখণ্ডে এ বোমা ব্যবহার করতে পারবে না কিয়েভ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে গুচ্ছবোমা দেওয়াকে ‘খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।

অস্বস্তিতে মার্কিন মিত্ররা

বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও স্পেন জানিয়েছে, তারা গুচ্ছবোমা ব্যবহারের পক্ষে নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক গত শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে গুচ্ছবোমার উৎপাদন, মজুত ও ব্যবহার বন্ধে ১২৩টি দেশ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই করেছে। এসব দেশের তালিকায় যুক্তরাজ্যও রয়েছে। যুক্তরাজ্য এ অস্ত্রের ব্যবহারকে সব সময় নিরুৎসাহিত করে।

গুচ্ছবোমা নিষিদ্ধের কনভেনশনের অন্যতম উদ্যোক্তা নিউজিল্যান্ড। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিনস বলেন, নির্বিচার ফেলা হয় বলে এ বোমায় নিরপরাধ মানুষের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে এসব বোমার প্রভাব থেকে যেতে পারে। ইউক্রেনে গুচ্ছবোমা ব্যবহারের নিউজিল্যান্ডের বিরোধিতার বিষয়টি হোয়াইট হাউসকে অবহিত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্পেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্গারিতা রোবলেস সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে কিছু কিছু অস্ত্র সরবরাহ করা যাবে না, এ বিষয়ে তাঁর দেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু গুচ্ছবোমা দিয়ে তা নিশ্চিত করা যাবে না।’

মার্কিন সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে কানাডা সরকারও। এতে বলা হয়েছে, বহু বছর ধরে অবিস্ফোরিত থাকতে পারে গুচ্ছবোমা। তাই এ বোমার ব্যবহার শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে কানাডা সরকারের উদ্বেগ রয়েছে। এ ছাড়া গুচ্ছবোমার ব্যবহার বন্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলার পক্ষে কানাডা।

সমালোচনায় জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো

এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো একদিন থেমে যাবে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এ অস্ত্র বেসামরিক মানুষের জীবনের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে রয়ে যাবে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। সংস্থাটির প্রতিনিধি বলেছেন, এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। কোনো ভূখণ্ডেই এই অস্ত্রের ব্যবহার হওয়া উচিত নয়।

গুচ্ছবোমা ব্যবহার না করতে ইউক্রেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। শনিবার এক টুইটে তিনি বলেন, ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের রুশ দখলকৃত এলাকায় গুচ্ছবোমা ব্যবহার করা হলে তা বহু বছর, এমনকি ১০০ বছর পর্যন্ত ইউক্রেনীয়দের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকির কারণ হয়ে থাকবে।

‘বেপরোয়া আচরণ’ বলছে রাশিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের গুচ্ছবোমা দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছে, তা রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেশটির ‘বেপরোয়া আচরণ’-এর আরেকটি নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ।

কিয়েভের শাসকদের হাতে মারণাস্ত্র তুলে দিয়ে ওয়াশিংটন ইউক্রেনের ধ্বংসযজ্ঞ বাড়াতে চাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন জাখারোভা। তিনি বলেন, বিতর্কিত গুচ্ছবোমা সতর্কতা ও দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউক্রেন। তবে তাদের এ প্রতিশ্রুতির কোনো দাম নেই। এটা ওয়াশিংটনও ভালোভাবে জানে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেছেন, তাঁর দেশের ভূখণ্ড দখলমুক্ত করতে এই অস্ত্র (গুচ্ছবোমা) সহায়তা করবে। তবে তিনি অঙ্গীকার করেছেন, কিয়েভ এই অস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে ব্যবহার করবে না।

পাঁচ কমান্ডারকে নিয়ে ফিরলেন জেলেনস্কি

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের সাবেক পাঁচ কমান্ডারকে তুরস্ক থেকে দেশে নিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। শনিবার ছিল ইউক্রেন যুদ্ধের ৫০০তম দিন। ঠিক এদিনই জেলেনস্কি তুরস্ক থেকে ইউক্রেনের সাবেক পাঁচ কমান্ডারকে নিয়ে দেশে ফেরেন।

ইউক্রেনের মারিউপোল সেনাশিবিরে (গ্যারিসন) কর্মরত ছিলেন সাবেক এ কমান্ডাররা। রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর বন্দী হিসেবে তাঁদের তুরস্কে পাঠানো হয়েছিল। ইউক্রেনের সাবেক পাঁচ কমান্ডারের মুক্তির নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনা গত বছর হওয়া বন্দিবিনিময় চুক্তির লঙ্ঘন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব ব্যক্তিকে তুরস্কে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আঙ্কারা।

এদিকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনের আগে গতকাল রোববার ইউক্রেন সফরে গেছেন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা।