এক শতাব্দী পর আবারও সাঁতারের জন্য উন্মুক্ত হলো প্যারিসের সেন নদী
প্যারিসের বুক চিরে চলে যাওয়া সেন নদী এক শতাব্দী পর সাঁতারের জন্য আবার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ১৯২৩ সালের পর প্রথমবার আজ শনিবার অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত নদীটিতে সাঁতার কাটলেন প্যারিসবাসী। দীর্ঘদিন ধরে পানি পরিষ্কার ও নিরাপদ করার কাজ শেষে এই বহু কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি এল ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত শহরটির বাসিন্দাদের জন্য।
গত বছর হয়ে যাওয়া প্যারিস অলিম্পিককে সামনে রেখে বছরজুড়ে ফ্রান্সের কিছু নদী পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে সেন নদীও পরিষ্কার করা হয়েছিল। এখন নদীটির তিনটি নির্ধারিত স্থানে রোজ ১ হাজারের বেশি মানুষ বিনা খরচে সাঁতার কাটতে পারবেন। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই সুযোগ থাকছে।
সেন নদী ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত প্যারিসের ডেপুটি মেয়র পিয়ের রবাদান বলেন, ‘আমরা বিশেষভাবে খুশি। কারণ, আমরা সন্দেহবাদীদের ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। শুরুতে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। কাজটি খুব বড় এবং জটিল ছিল।’
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টির দিনে পুরোনো প্যারিসের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা প্রায়ই উপচে পড়ত। তখন বৃষ্টির পানি আর বর্জ্য একসঙ্গে সেন নদীতে চলে আসত। ফলে নদীটি বেশ নোংরা থাকত। এই অবস্থায় ১৯২৩ সালে নদীটিতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ করা হয়।
১০২ বছরে নদীটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। এবার সেনের পানির মান উন্নয়নে খরচ হয়েছে প্রায় ১৬০ কোটি ডলার।
পানি নিরাপদ রাখতে দুই তীরের অনেক বাসাকে নতুন করে আধুনিক পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। পানি শোধনাগারগুলোর আমূল সংস্কার করা হয়েছে। ভারী বৃষ্টির সময় ময়লা পানি যেন সরাসরি নদীতে পড়তে না পারে, সে জন্য বড় ট্যাংক তৈরি করা হয়েছে। গত বছর প্যারিস অলিম্পিকের জলক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়েছিল এখানে। এটা মানুষের মধ্যে নদীর পানি নিরাপদ বলে বিশ্বাস বাড়িয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সাঁতারের মৌসুমে প্রতিদিন নদীর পানি পরীক্ষা করা হবে। সবুজ পতাকা থাকলে সাঁতার কাটা যাবে। আর লাল পতাকা থাকলে যাবে না। পিয়ের রবাদান বলেন, ‘সাঁতারের জায়গা (পয়েন্ট) খোলা থাকলে বুঝতে হবে পানি নিরাপদ এবং ঝুঁকি নেই।’
প্যারিসের তিনটি জায়গার বাইরে সেন ও মার্ন নদীতে আরও ১৪টি সাঁতারের স্থান চালু হয়েছে। মার্ন নদীর দুটি সাঁতারের স্থান সেনের আগেই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। মার্ন প্যারিসের কাছাকাছি এলাকায় এসে সেনের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
সেনে নামার জন্য শনিবার সকাল আটটার আগেই অনেকে চলে আসেন। প্যারিসের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে আসা ৫১ বছর বয়সী কারিন বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম পানি ঠান্ডা হবে। কিন্তু সাঁতার কেটে যে আনন্দ পেলাম, তাতে ঠান্ডার ভয় সে তো ছাই।’
প্যারিসের মেয়র আন হিদালগো বলেন, ‘একদিন সবাই নদীতে সাঁতার কাটবে—এটাই ছিল আমার শৈশবের স্বপ্ন। এটা বাস্তবায়ন হওয়ায় আমি খুব খুশি।’ নিরাপদ সাঁতারের জায়গা তৈরি মানেই জীবনমান উন্নত করা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেনে সাঁতার কাটার সময় সতর্ক থাকতে হবে। নদীটির প্রবাহ শক্তিশালী। গভীরতা প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিটার। স্থানীয় কর্মকর্তা এলিজ লাভিয়েল বলেন, ‘সেন নদী এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সেনে নামার আগে সাঁতারুদের দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হবে এবং অনুমোদিত জায়গার বাইরে সাঁতার করলে জরিমানা করা হবে।’
সেন নদীতে সাঁতারে নিষেধাজ্ঞা তোলার প্রথম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তৎকালীন প্যারিসের মেয়র ও ভবিষ্যতের ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে তখন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ লিখেছেন, ‘আমাদের পূর্বসূরি জ্যাক শিরাক এমন এক সেন নদীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে সবাই সাঁতার কাটতে পারবে।’ এখন তা বাস্তবায়িত হওয়াকে ‘সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ফল’ এবং ‘ফ্রান্সের জন্য গর্বের মুহূর্ত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
৭৭৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেন নদীর উৎপত্তি ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লাঙ্গ্রেস মালভূমিতে। পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে প্যারিস শহরের মধ্য দিয়ে নদীটি লা মাঞ্চা বা ইংলিশ চ্যানেলে গিয়ে মিশেছে। ফ্রান্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নদীর তীরে আইফেল টাওয়ার, নটরডেম ক্যাথেড্রাল এবং ল্যুভর জাদুঘরের মতো বিখ্যাত অনেক আধুনিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে।