রাশিয়া-ইউক্রেনের কাছে বাখমুতের গুরুত্ব কেন এত বেশি

বিধ্বস্ত বাখমুত শহর
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

চলতি ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাখমুত শহর থেকে ক্রমাগত সেনা প্রত্যাহার করেছে ইউক্রেন। তবে তারা রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে পূর্বাঞ্চলীয় এ শহরের নিয়ন্ত্রণ এখনো ধরে রেখেছে। সেনা প্রত্যাহারকে কৌশলগত পদক্ষেপ উল্লেখ করে ইউক্রেন বলেছে, বাখমুতের জন্য তারা অযথা সেনাদের হারাতে চায় না। তবে এরপরও ইউক্রেনীয় বাহিনী এ শহর থেকে পুরোপুরি সরেনি। কেন এ বিধ্বস্ত শহরটিতে ইউক্রেন এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে বার্তা সংস্থা এএএফপি, আল-জাজিরা।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অন্যতম লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক প্রদেশের জয়। এ ক্ষেত্রে বাখমুতকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে রাশিয়া। লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে একসঙ্গে দনবাস নামে ডাকা হয়ে থাকে। বাখমুতের অবস্থান দোনেৎস্কে।

আরও পড়ুন

যুদ্ধের আগে এ শহরে জনসংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। এক বছরের বেশি সময় আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তাক্ত লড়াই হচ্ছে এই বাখমুতে।

লড়াই দেখে মনে হচ্ছে, রাশিয়া যেকোনো মূল্যে এ শহরের দখল নিতে চায়।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু সম্প্রতি এক বৈঠকে সামরিক কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘বাখমুত দখল করতে পারলে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের আরও ভেতরে অভিযান চালাতে পারবে।’

সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি, বাখমুতের পর তারা আরও সামনে এগোবে। তারা ক্রামাতোরস্কের দিকে যেতে পারে। স্লোভিয়ানস্কের দিকে যেতে পারে। বাখমুত দখল করতে পারলে রুশ সেনাদের জন্য দোনেৎস্ক অভিমুখে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

ইউক্রেন একটি কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যতক্ষণ সম্ভব তারা বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবে।

আরও পড়ুন

জেলেনস্কিও বলেছেন, তাঁর শীর্ষ কমান্ডাররা বাখমুতে প্রতিরক্ষা অভিযান অব্যাহত রাখতে এবং নিজেদের অবস্থান আরও জোরদার করতে কাজ করছেন। তবে কেন সেখানে তাঁরা আঁকড়ে থাকতে চান, সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি অব ওয়ার বলছে, বাখমুত দখলের চেষ্টা চালাতে গিয়ে রুশ বাহিনীকে অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। তারপরও যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যান্য অংশের চেয়ে তারা এ এলাকার দিকে বেশি মনোনিবেশ করছে।
স্টাডি অব ওয়ারের যুদ্ধসংক্রান্ত এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার লড়াইয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী বেশ ভালো অবস্থানে আছে। তাদের প্রতিরোধের মুখে রুশ বাহিনী ক্রমাগত জনবল হারাচ্ছে, তাদের সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে বাখমুতের লড়াইয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠান বলছে, শহর দখলের এ লড়াইয়ে সহসা রুশ বাহিনীর উল্লেখজনক কোনো অর্জনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এতে সাধারণত প্রতিপক্ষ সুবিধা পায়। রুশ সেনা দলগুলো ব্যাপকভাবে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে এবং তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

বাখমুতের লড়াইয়ে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দাবি

ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিষদের সেক্রেটারি ওলেকসি দানিলব বলেন, বাখমুতে প্রতি একজন ইউক্রেনীয় সেনার মৃত্যুর বিপরীতে সাতজন করে সেনা হারাচ্ছে রাশিয়া।

বাখমুতে শুরু থেকে রাশিয়ার বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ভাগনারের সেনারা বেশ ভালোভাবে লড়াই চালিয়ে আসছে। তবে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলেন, বাখমুত দখলের লড়াইয়ে এক বছরে ভাগনার প্রায় ৯ হাজার সেনা হারিয়েছে।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযানের শুরুতে ১ লাখ ৯০ হাজার সেনা পাঠিয়েছিল রাশিয়া। এরপর ক্রমান্বয়ে আরও ৩ লাখ ১৬ হাজার সেনা যোগ করা হয়। ইউক্রেনের দাবি, যুদ্ধে এ পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছে।
তবে ইউক্রেনের এ দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান কিরিলো বুদানভ ইউএসএ টুডেকে বলেন, রাশিয়া যে ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাতে তাদের এ বসন্তে বড় ধরনের অভিযান চালানোটা কঠিন হবে।

সংবাদপত্রটিকে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান আরও বলেন, রাশিয়ার বিপুল মানবসম্পদ, অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ উপকরণ নষ্ট হয়েছে। এ ক্ষয়ক্ষতি সামলানোর মতো অর্থনীতি ও উৎপাদন সক্ষমতা দেশটির নেই। রাশিয়া যদি এ বসন্তে সামরিকভাবে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের কাছে আর কোনো সামরিক হাতিয়ার থাকবে না।

ইউক্রেন কেন বাখমুত ছাড়ছে না

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাখমুত থেকে সেনা প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দেয় ইউক্রেন। এদিন দেশটির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আলেক্সান্ডার রডনিয়ানস্কি একে কৌশলগত সেনা প্রত্যাহার বলে উল্লেখ করেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদের সেনারা শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। তবে প্রয়োজন হলে তাদের কৌশলগতভাবে প্রত্যাহার করা হবে। অযথা আমরা আমাদের সব সেনাকে বিসর্জন দিতে পারব না।’

পরদিন ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য সেরহি রাখমানিন এনভি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কোনো না কোনো সময় আমাদের বাখমুত ছাড়ার প্রয়োজন হতে পারে। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে এটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার কোনো মানে নেই। তবে এ মুহূর্তে কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে আমরা এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করব। প্রথমত, যতটা সম্ভব রাশিয়ার বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি করানো, রাশিয়াকে দিয়ে গোলা বারুদ ও তাদের সক্ষমতাগুলোর ব্যবহার করানো।’

পরবর্তীকালে ইউক্রেনীয় বাহিনী বাখমুত এলাকার ভেতরের ও আশপাশের সেতুগুলো উড়িয়ে দেওয়া শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, ইউক্রেন রাশিয়ার অগ্রগতি ধীর করতে চাইছে, যেন বাখমুত দখলের পর তারা দ্রুত পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে না পারে।

ইউক্রেনের বাখমুত শহর
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

গত বুধবার রাশিয়ার বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ভাগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন দাবি করেছেন, তাঁর বাহিনী বাখমুত এলাকার অর্ধেকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তাঁর দাবি, বাখমুতে এখনো ১২ থেকে ২০ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা সদস্য রয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, বাখমুতকে রাশিয়া বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় ইউক্রেন সুবিধা পাওয়ার পরও রাশিয়া কেন তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনছে না?

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক আভ্রিল হেইন্স গত বুধবার সিনেট গোয়েন্দা কমিটিকে বলেন, পুতিন হয়তো হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন, সময়টা তাদের অনুকূলে কাজ করছে এবং যুদ্ধকে বিলম্বিত করছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য এটি হয়তো তাঁর জন্য সবচেয়ে ভালো পথ। এ জন্য কয়েক বছর লাগলেও সমস্যা নেই।

তবে অন্য পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের মতো করে হেইন্সও বিশ্বাস করেন, এ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট জনবল ও উপকরণ রাশিয়ার নেই।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান কিরিলো বুদানভ ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে একমত প্রকাশ করেন। অনেক বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রাশিয়ার নেই। তারা যতটা সম্ভব দেখানোর চেষ্টা করেছে, দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি তাদের আছে।

আরও পড়ুন

বুদানভ মনে করেন, বাস্তবে রাশিয়ার যুদ্ধ উপকরণ ও জনবল একেবারেই সীমিত। আর তারা তা ভালো করেই জানে।

এদিকে ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে নিজেদের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ করছে। বসন্তকালে বড় ধরনের পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।

জার্মানি ও পোল্যান্ড বলেছে, তারা চলতি মাসে ইউক্রেনকে ২৮টি লেপার্ড ট্যাংক সরবরাহ করবে। সব মিলে মিত্রদের কাছ থেকে ইউক্রেনের পাওয়া ট্যাংকের সংখ্যা ২২৭টিতে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ইউক্রেনকে ২০০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান কিরিলো বুদানভ বলেছেন, এ বসন্তে ইউক্রেন চূড়ান্ত লড়াই চালাবে। আর এটি হবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে সর্বশেষ লড়াই।