পাঁচ ফটোসাংবাদিকের বয়ানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের গল্প

ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হামলার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হয়ে এসেছে। ২০২২ সালের মার্চে রাশিয়া এটি দখল করে নেয়ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করার পর গত তিন বছরে শত শত আলোকচিত্রী সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্র ও অসামরিক বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যুদ্ধের মানবিক প্রভাবের চিত্র ধারণ এবং সংরক্ষণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে বিবিসিতে প্রকাশিত নিজেদের বিভিন্ন ছবির পেছনের গল্প শুনিয়েছেন।

ভ্লাদা ও কোস্টিয়ানটিন লিবেরভ

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ভ্লাদা ও কোস্টিয়ানটিন লিবেরভ কৃষ্ণসাগরীয় বন্দরনগরী ওডেসায় প্রতিকৃতি এবং বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি তুলতেন। ভ্লাদা জানান, অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা প্রেমের গল্পের বদলে ক্যামেরার ফ্রেমে রাশিয়ার ‘যুদ্ধাপরাধের’ দৃশ্য ধারণ করতে শুরু করেন। তিনি শুরু থেকেই তাঁর কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতেন। ২০২৩ সালে দোনেৎস্ক অঞ্চলে ভ্রমণের সময় এক বিস্ফোরণে তাঁর শরীরে বোমার কিছু টুকরা ঢুকে যায়। এসব টুকরা বের করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত জানান চিকিৎসকেরা।

২০২৪ সালের গ্রীষ্মে কোস্টিয়ানটিন লিবেরভের তোলা একটি শক্তিশালী ছবি বিবিসিতে প্রকাশিত হয়েছিল। রাশিয়ার কুরস্ক সীমান্তে ইউক্রেনের হামলাসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরার পর নিহত সহকর্মীর শোকে ভেঙে পড়েছেন এক ইউক্রেনীয় সেনাসদস্য। তাঁকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁর আরেক সহকর্মী।

আলেকজান্ডার এরমোশেঙ্কোর তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রুশ যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা বোমায় ধ্বংস হয়ে গেছে ইউক্রেনের মারিওপোল থিয়েটার
ছবি: রয়টার্স

লিবেরভের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দেশটির সামরিক বাহিনীর মধ্যকার কিছু বিভ্রান্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছে ছবিটি। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে আমাদের দেশকে রক্ষা করার চেয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ চালাতে গিয়ে নিজের বন্ধুকে হারানো খুবই কঠিন। আমি এ ছবিটি তুলেছি কারণ, ঘটনাটি আমার ওপর আবেগঘন প্রভাব ফেলেছিল। যুদ্ধের পরিস্থিতি এবং এটি তাঁদের জন্য কতটা কঠিন ছিল, সে ব্যাপারে অনেক কথা বলে ছবিটি।’

এ ছবি স্থানীয় ফটোসাংবাদিকদের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। ভ্লাদা বলেন, ‘এটি এতটাই বেদনাদায়ক যে আমরা সহকর্মীরা এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করি না। আমরা খুব কঠিন পরিস্থিতিতে আছি। কেউ বুঝতে পারছি না, এর সমাধান কী হতে পারে।’

২০২৩ সালে ভ্লাদার তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, আভদিভকা অঞ্চলে রুশ বাহিনী ঢুকে পড়ার আগে শহরটি ছেড়ে যাওয়ার জন্য সেখানকার অবশিষ্ট বাসিন্দাদের একজনকে রাজি করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন ইউক্রেনের হোয়াইট অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ইউনিটের এক সদস্য।

ভ্লাদা বলেন, ‘এক ব্যক্তি পুলিশের ওই ইউনিটকে পুড়ে যাওয়া একটি ভবনের বেজমেন্ট থেকে তাঁর ভাইকে বের করে আনার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি বাড়িটি থেকে বের হয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানান। পর দিন তীব্র গোলাগুলির কারণে আমরা আর সেখানে যেতে পারিনি। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাওয়া তিনি বেঁচে আছেন কি না, তা–ও নিশ্চিত হতে পারিনি। ওই জায়গায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব জেনে কষ্ট হয়েছে।’

ক্ষয়ক্ষতি ও ভোগান্তির ঘটনা ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করার মাধ্যমে এ দম্পতি আনন্দের মুহূর্তগুলোর গভীরতা উপলব্ধি করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

সেনাসদস্য দিমিত্র ইউক্রেনে লড়াই করছেন। ২০২৪ সালের মার্চে তাঁর স্ত্রী সন্তান প্রসব করার পর তাঁদের একটি ছবি তোলা হয়েছিল। লিবেরভ ছবিটি তোলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিখায় তাঁর ছবি তুলতাম। আর আপনি যখন দেখবেন যে এ সাহসী সেনা তাঁর ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে কাঁদছে, তখন বুঝতে পারবেন, তাঁর মতো সেনারা এমন মুহূর্তের জন্য লড়াই করেননি। শুধু নিজেদের জন্য নয়, তাঁরা ইউক্রেনের সবার জন্য লড়াই করেন।’

ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর তিন দিন আগের আলেকজান্ডার এরমোশেঙ্কোর তোলা এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দোনেৎস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করায় উল্লাস করছেন সেখানকার রুশপন্থীরা
ছবি: রয়টার্স

ভ্যালেরিয়া ডেমেঙ্কো

২০১৬ সাল থেকে লম্বা সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সুমি অঞ্চলে ইউক্রেনের জরুরি পরিষেবা (ডিএসএনএস) কার্যক্রম নথিভুক্ত করার কাজ করেছেন ভ্যালেরিয়া ডেমেঙ্কো। এখন তিনি রুশ সেনাবাহিনীর গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নিয়োজিত ডিএসএনএসের উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে সরাসরি যোগ দিয়েছেন।

ভ্যালেরিয়া বলেন, ‘এ কাজটি সব সময়ই কঠিন...আপনি কখনোই জানতে পারবেন না যে আপনার জন্য কী বিপদ অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি, যখন আবাসিক ভবনগুলো হামলার শিকার হয়।’

একটি মুহূর্ত এখনো ভ্যালেরিয়ার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। ২০২৪ সালের মার্চে ছবিসহ ওই ঘটনার একটি খবর প্রকাশিত হয়। ছবিতে দেখা গেছে, রাশিয়ার গোলার আঘাতে ধসে পড়া পাঁচতলা ভবনে উদ্ধারকাজ করছেন জরুরি পরিষেবা কর্মীরা। ভবনটিতে আটকা পড়ে আছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

ভবন ও অবকাঠামোয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর প্রায়ই সবার আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ডিএসএনএসের সদস্যরা।

জরুরি পরিষেবা কর্মীরা কীভাবে টানা চার দিন ওই ভবনে উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন, স্মৃতি হাতড়ে সেই বর্ণনা দেন ভ্যালেরিয়া। বলেন, উদ্ধারকারীরা সেখান থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেন। কিন্তু তাঁরা একটি নিখোঁজ মেয়ের মরদেহ কখনোই খুঁজে পাননি।

ভ্যালেরিয়া আরও বলেন, ‘ভবনের ওপরের একটি তলায় একটি পুতুল পাওয়া গেছে। এর অর্থ, সেখানেও একটি শিশু ছিল। ওই ভবনে হয়তো এর বাইরে আরও শিশু ছিল।’

ভ্যালেরিয়ার আলোকচিত্রী সহকর্মীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও তিনি চান বিশ্ব তাঁদের কাজ দেখুক। তিনি বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অপরাধ নথিভুক্ত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।’

আরও পড়ুন

আলেকজান্ডার এরমোশেঙ্কো

আলেকজান্ডার এরমোশেঙ্কো গত ১১ বছর ধরে পূর্ব দোনেৎস্ক অঞ্চলে ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন তিনি। প্রায়ই রাশিয়ানিয়ন্ত্রিত অঞ্চলেও কাজ করেন তিনি। এই ফটোসাংবাদিক বলেন, ‘কখনো ভাবিনি, আমাকে আমার বাড়িতে বসেই যুদ্ধের ছবি তুলতে হবে।’

আলেকজান্ডার বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেন—উভয় পাশেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িগুলোর মালিকদের মুখে ভয়ের ছাপ একই রকমের। সবার রক্তের রং একই—লাল। আর এ বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ।’

রাশিয়ার ফটোসাংবাদিকদের সঙ্গে বিবিসির কথা বলার সুযোগ কম। কারণ, ক্রেমলিন আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সীমিত করে রেখেছে। রাশিয়ার সংবাদ সংস্থাগুলো মূলত রাষ্ট্রপরিচালিত। এ প্রতিবেদনের জন্য বিবিসি রুশভিত্তিক একজন আলোকচিত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তাতে সাড়া পায়নি।

আরও পড়ুন

আলিনা স্মুটকো

কিয়েভভিত্তিক ফটোসাংবাদিক আলিনা স্মুটকো। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই যুদ্ধের মানবিক প্রভাব বোঝেন। তিনি বলেন, ‘আমি তিন বছর ধরে প্রায় অবিরামভাবে কিয়েভ শহরে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এ সময় আমি আমার বাবা-মা, সন্তান, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের জন্য চিন্তিত ছিলাম।’

আলিনা স্মুটকোর তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনের হোয়াইট অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ইউনিটের এক সদস্য রুশ হামলার আগে তরেৎস্ক অঞ্চলের একজন বাসিন্দাকে এলাকা ছেড়ে যেতে অনুরোধ করছেন
ছবি: রয়টার্স

নিজের শোবার ঘরের জানালা থেকে আশপাশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দৃশ্য দেখেছেন এ ফটোসাংবাদিক। এর মধ্যেও নিজের ঘর অক্ষত থাকায় ও প্রিয়জনেরা বেঁচে যাওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন তিনি।

সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম দিকে আলিনা স্মুটকো তাঁর বন্ধুবান্ধব ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিন একে অপরের খবর নিতেন। কিন্তু অব্যাহত আক্রমণ স্থানীয় বাসিন্দাদের যুদ্ধের মধ্যে বেঁচে থাকতে এবং এর মধ্যেই যতটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছে। যুদ্ধ তাঁর পেশাগত জীবনেও কঠিন প্রভাব ফেলেছে।

আলিনা বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের সহকর্মীরা, বিশেষ করে ফটোসাংবাদিকেরা এ আক্রমণের সময় কীভাবে নিহত বা আহত হয়েছেন। আমরা আমাদের দলের একজন সদস্যকে হারিয়েছি এবং অন্য একজন সহকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন।’

আলিনা তাঁর কাজ নিয়ে ‘অতিরিক্ত চিন্তা’ না করার চেষ্টা করেন। তবে বিশ্বাস করেন যে যুদ্ধের প্রভাব (ছবির মাধ্যমে) বিশ্বের সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করবে। কিন্তু আমি এ ধারণায় বিশ্বাস করি না যে একটি ছবি যুদ্ধ থামাতে পারে। যদি এটি সম্ভব হতো, তবে আমাদের এখানে এত প্রাণ হারাতে হতো না।’

আরও পড়ুন