রয়টার্সের বিশেষ প্রতিবেদন
যুদ্ধক্ষেত্রে ভালো করছিল ইউক্রেন, হঠাৎ স্টারলিংক বন্ধের নির্দেশ দেন মাস্ক
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন সেনারা যখন ভালো করছিলেন, তখন স্টারলিংকের ইন্টানেট সেবা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন ইলন মাস্ক। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশেষ প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, যুদ্ধক্ষেত্রে স্টারলিংকের সেবা বন্ধে করে দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
ইউক্রেনের সেনারা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে নিজেদের হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে রাশিয়ায় পাল্টা হামলায় ব্যস্ত ছিলেন। এই সময়ে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের মালিক ধনকুবের ইলন মাস্ক সেবা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে ইউক্রেনের পাল্টা হামলা বিঘ্নিত হয়েছিল।
রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা চালায়। স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক এই যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেন সেনাবাহিনীর জন্য সেবা দেওয়া শুরু করে। যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাদের যোগাযোগ বজায় রাখতে এই সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বরে মাস্কের সেবা বন্ধের নির্দেশের পর স্টারলিংকের সেবার প্রতি কিয়েভের আস্থায় চিড় ধরে।
ইউক্রেনের কমান্ডের বিষয়ে জানাশোনা আছে এমন তিন ব্যক্তির মতে, স্পেসএক্সের ক্যালিফোর্নিয়া কার্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীকে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগর খেরসনসহ কিছু এলাকায় স্টারলিংক সেবা বন্ধ করতে বলেছিলেন মাস্ক। খেরসন কৃষ্ণসাগরের উত্তরে অবস্থিত একটি কৌশলগত নগর, যেখানে ওই সময়ে ইউক্রেনের সেনারা রুশ বাহিনীর কাছ থেকে কিছু ভুখণ্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন।
তিন ব্যক্তির একজন জানান, মাস্কের নির্দেশ আদেশ পাওয়ার পর স্টারলিংকের প্রকৌশলী মাইকেল নিকোলস সহকর্মীদের বলেছিলেন, ‘আমাদের এটা করতে হবে।’ ওই তিন ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, সংস্থাটির কর্মীরা নির্দেশ মেনে চলছিলেন। তাঁরা অন্তত ১০০ স্টারলিংক টার্মিনাল নিষ্ক্রিয় করেছিলেন। এর প্রভাব পড়েছিল রুশ বাহিনীর দখলে থাকা ইউক্রেনের অন্যান্য এলাকা, বিশেষ করে দোনেৎস্ক প্রদেশের কিছু অংশেও; যেখানে ইউক্রেনের সেনাদের অভিযান চলছিল।
মাস্কের নির্দেশের পর ইউক্রেনের সেনারা হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হন। ইউক্রেনের একজন সেনা কর্মকর্তা, সশস্ত্র বাহিনীর একজন উপদেষ্টা এবং আরও দুজন রণক্ষেত্রের সম্মুখভাগের (ফ্রন্ট লাইনের) কাছাকাছি এলাকায় স্টারলিংকের সংযোগ বিঘ্নিত হওয়ার কথার জানিয়েছেন। এমনটি হওয়ার ইউক্রেনের সেনারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন, রুশ বাহিনীর ওপর নজরদারি করা ড্রোনগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল এবং দূরপাল্লার গোলন্দাজ ইউনিটগুলোকে নিশানায় আঘাত করতে বেগ পেতে হচ্ছিল। কারণ, লক্ষ্য ঠিক করতে তাঁরা স্টারলিংকের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
ইউক্রেনের ওই সামরিক কর্মকর্তা ও সামরিক উপদেষ্টা জানান, স্টারলিংক সংযোগ না থাকায় খেরসনের পূর্ব দিকে বেরিসলাভ শহরে রাশিয়ার সেনাদের ঘিরে ফেলতে তাঁদের সেনারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই সামরিক কর্মকর্তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, (এই পরিস্থিতিতে) ঘিরে ফেলার অভিযান পুরোপুরি থমকে যায়। পরে যা ব্যর্থ হয়।
শেষ পর্যন্ত পাল্টা হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনের সেনারা বেরিসলাভ, খেরসন নগর এবং রাশিয়া দখল করা আরও কিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাস্কের স্টারলিংক সেবা বন্ধে করে দেওয়ার এই নির্দেশ নিয়ে আগে কোনো প্রতিবেদন হয়নি। আর মাস্ক নিজেই সক্রিয় হয়ে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে স্টারলিংকের সেবা বন্ধে করে দেওয়ার এটাই প্রথম ঘটনা।
মাস্কের এই সিদ্ধান্ত স্টারলিংকের কিছু কর্মীকে চমকে দিয়েছিল এবং রণক্ষেত্রের সম্মুখভাগকে কার্যকরভাবে বদলে দিয়েছিল। ইউক্রেনের কমান্ডের সঙ্গে পরিচিত তিন ব্যক্তির একজন বলেন, এমন ক্ষমতা থাকায় মাস্ক ‘যুদ্ধের ফলাফল নিজের হাতে নিয়ে নিতে’ সক্ষম হয়েছিলেন।
ইউক্রেনের কমান্ডের বর্ণনার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে স্টারলিংকের সেবা পরিচালনার বিষয়ে মাস্কের ভাষ্যের মধ্যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে। গত মার্চ মাসে নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক্সে এক পোস্টে মাস্ক লিখেছিলেন, ‘আমরা কখনোই এমন কিছু করব না।’
ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে স্টারলিংকের সেবা বন্ধের বিষয়ে জানতে মাস্ক এবং মাইকেল নিকোলসের সঙ্গে রয়টার্সের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্পেসএক্সের এক মুখপাত্র ই-মেইলে রয়টার্সের প্রতিবেদনকে ‘অসত্য’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি চলতি বছরের শুরুর দিকে এক্সের একটি পোস্টের দিকে সাংবাদিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। ওই পোস্টে বলা হয়েছিল, ‘স্টারলিংক ইউক্রেনকে সেবা দিতে সম্পূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
কিন্তু স্পেসএক্সের ওই মুখপাত্র রয়টার্সের প্রতিবেদনের কোন অংশটি অসত্য, তা সুনির্দিষ্ট করেননি। পাশাপাশি, ইউক্রেনে যুদ্ধ স্টারলিংকের ভূমিকা–সংক্রান্ত অনেকগুলো প্রশ্ন বা তাদের ব্যবসা-সংক্রান্ত বিস্তৃত প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কার্যালয় এবং দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছেও স্টারলিংকের সেবা বন্ধের বিষয়ে প্রশ্ন করে কোনো মন্তব্য পায়নি রয়টার্স। স্টারলিংক এখনো ইউক্রেনে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু যোগাযোগের জন্য ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এই স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল। জেলেনস্কি সম্প্রতি স্টারলিংকের জন্য মাস্ককে ধন্যবাদ দিয়েছেন।
কী কারণে ও ঠিক কখন মাস্ক স্টারলিংক বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন, কিংবা সুনির্দিষ্টভাবে কত সময় স্টারলিংকের পরিষেবা বন্ধ ছিল, তা স্পষ্ট নয়। মাস্কের নির্দেশের সঙ্গে পরিচিত তিন ব্যক্তি বলেন, তাঁদের বিশ্বাস, কিছু উদ্বেগ থেকে মাস্ক এই আদেশ দিয়ে থাকতে পারেন, যা তিনি পরে প্রকাশ করেছেন। তা হলো, মাস্কের আশঙ্কা ছিল, ইউক্রেনের অগ্রগতির মুখে রাশিয়া পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে জবাব দিতে পারে।
তিন ব্যক্তির একজন বলেন, স্টারলিংকের সেবা বন্ধের ঘটনা ঘটেছিল ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। অন্য দুজন বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বরের কাছাকাছি সময়টাতে এ ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখ তাঁদের মনে পড়ছে না।
হোয়াইট হাউসের সাবেক এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, উচ্চপদস্থ কিছু মার্কিন কর্মকর্তাও মাস্কের মতোই আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, রাশিয়া উত্তেজনা বৃদ্ধির যে হুমকি দিচ্ছিল, তা বাস্তবায়ন করতে পারে।
স্টারলিংকের মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে ইলন মাস্ক কীভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন, ওই নির্দেশে সেটারই প্রাথমিক আভাস রয়েছে। অথচ দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকা তাঁর এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চলতি দশকের শুরুতেও প্রায় অস্তিত্বহীন ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা বিশ্বের কিছু প্রত্যন্ত এলাকাতেও পৌঁছে গেছে।
সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক ও পরামর্শদাতা হওয়ার আগেই স্টারলিংকের সফলতা এবং বিশ্বজুড়ে এর দুর্দান্ত ইন্টারনেট–সংযোগ বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ককে অনেক বেশি পরিচিত করেছে। এটা মাস্ককে বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে এবং প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করেছে।