পুতিন ও কিম জং-উনের এই বন্ধুত্বে কার কী লাভ

রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর ভ্লাদিভস্তকে ২০১৯ সালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভ্লাদিমির পুতিন ও  কিম জং-উন
ফাইল ছবি: এএফপি

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন রাশিয়া সফরে গেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং-উনের মধ্যে এখন বন্ধুত্বের সম্পর্কে নতুন মাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ দুজনের মধ্যে অনেক সাধারণ মিলও আছে। তাঁরা দুজনই খুব একটা বাইরে যান না। পুতিন চলতি বছর রাশিয়া ছেড়ে কোথাও যাননি। আর কিমের ক্ষেত্রে সময়টা চার বছর। দুই দেশের বিরুদ্ধেই ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমাদের। তা ছাড়া বর্তমানে দুই দেশের বিরুদ্ধেই কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর।

রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ‘আধিপত্যের’ বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিষয়টিই মূলত দুই নেতাকে কাছাকাছি এনেছে। তাঁরা দুজন এখন মূলত প্রয়োজনের বন্ধু। এই ২০২৩ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এই বন্ধুত্ব থেকে দুজনই লাভবান হতে পারেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

লাভের হিসাব
পুতিন ও কিমের এই সম্পর্কে ক্রেমলিনের কী লাভ? আছে। উত্তর কোরিয়ায় একটি বিশাল প্রতিরক্ষা শিল্প খাত রয়েছে। সেই খাতের বড় মাত্রায় উৎপাদন ক্ষমতাও আছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য যুদ্ধাস্ত্রের বড় জোগানদার হয়ে উঠতে পারে পিয়ংইয়ং। গত রোববার কিম জং-উন সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে বুলেটপ্রুফ ট্রেনে করে রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে অস্ত্র আলোচনা সক্রিয়ভাবে অগ্রসর করতে তিনি রাশিয়া সফর করছেন বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে অস্ত্র আলোচনা ‘সক্রিয়ভাবে অগ্রসর’ হয়েছে। উত্তর কোরিয়া রাশিয়ায় গোলাবারুদ ও কামানের গোলা সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ ওয়াশিংটনের। তবে এ বিষয়ে রাশিয়ার কর্মকর্তারা এখনো কিছু নিশ্চিত করেননি। যদিও রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে চায় এমন অনেক ইঙ্গিত রয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার প্রথম প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সের্গেই শোইগু গত জুলাইয়ে উত্তর কোরিয়া সফর করেন। তিনি কোরীয় যুদ্ধবিরতির ৭০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। কিম জং-উন তাঁকে একটি অস্ত্র প্রদর্শনী ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। সে সময় সের্গেই শোইগুও ইঙ্গিত দেন, দুই দেশের যৌথ সামরিক মহড়া আলোচনায় আছে।

রাশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই কোজিরেভ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সেখান থেকে ভিডিও কলে তিনি বিবিসিকে বলেন, যদি তাঁরা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, স্বল্পোন্নত দেশ ও একটি বিচ্ছিন্ন দেশ উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র নিতে চান, তাহলে রাশিয়া ‘বৃহৎ শক্তি’ হিসেবে যে প্রচার চালানো হয়, তার চরম অপমান হবে। একটি বৃহৎ শক্তি জোট বা সামরিক সরবরাহের জন্য কখনো উত্তর কোরিয়ার কাছে যাবে না।

যে কারণে বন্ধু হলেন কিম
পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে পাল্টে দিতে পারে। ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় সংঘাতের মাধ্যমে পুতিনের নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থার জন্য যে পরিকল্পনা রয়েছে, সেটার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তিনি। এবার উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতা সেই আকাঙ্ক্ষার আরেকটি দিক হতে পারে।

মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে যদি অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে চুক্তি হয়, তাহলে তা বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দেবে। এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জন্য উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রাশিয়ার অবস্থান রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অস্ত্রবাণিজ্যও নিষিদ্ধ।

নিরাপত্তা পরিষদের ওই সব প্রস্তাবে রাশিয়ারও সই থাকার বিষয়টি গত সপ্তাহেই পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয় রুশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস। তবে সেখানে এটাও বলা হয় যে ‘এটা কোনো বিষয় নয়। স্বাক্ষর প্রত্যাহারও করা যায়।’

এ বিষয়ে মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস রাশিয়ার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ফিওদর লুকিয়ানভকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন করা হচ্ছে, কেন আমরা (রাশিয়া) এই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছি? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পুরো ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই বৈধ। এটা অগ্রাহ্য করা কঠিন। আমরা তাদের পক্ষে ভোট দিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেছে। কেন আমাদের ভোট প্রত্যাহার করা হচ্ছে না?’

রাশিয়ার এই বক্তব্য মূলত কিম জং-উনের কানে বাজছে, তাঁকে রাশিয়ার বন্ধু হতে উৎসাহ দিচ্ছে। কারণ, রাশিয়া যদি নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে দেওয়া স্বাক্ষর প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে সহজেই তারা রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য করতে পারবে।

এ বন্ধন যাবে কি ছিঁড়ে?
রাশিয়া না হয় উত্তর কোরিয়ার কাছে অস্ত্র পাবে, কিন্তু উত্তর কোরিয়া কী পাবে? এ প্রশ্নের জবাবে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, উত্তর কোরিয়ার খাদ্যঘাটতি দূর করতে মানবিক সহায়তা দিতে পারে মস্কো। পিয়ংইয়ং পারমাণবিক সাবমেরিনসহ স্যাটেলাইট ও সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য রাশিয়ার উন্নত প্রযুক্তি চেয়েছে বলেও আলোচনা রয়েছে।

ইউক্রেনের সঙ্গে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য প্রকৃত অর্থে ভালো হয়নি। এতে অনেক অস্ত্র খরচ হয়েছে। এ কারণে মস্কোকে আবার অস্ত্রের মজুত করতে হবে। এই অস্ত্রের মজুতের উপায় হিসেবে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে একটি চুক্তি হতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে উত্তর কোরিয়ার সাহায্য ছাড়া রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না।

রাশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই কোজিরেভ বলেন, পুতিন এর জন্য মরিয়া নন। তিনি এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে পারেন। এর সঙ্গে মানিয়েও নিতে পারেন। কীভাবে নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যায়, কীভাবে চীন ও আফ্রিকার কিছু দেশের সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো যায়, তা তিনি প্রতিদিন বোঝার চেষ্টা করছেন। এটা ভবিষ্যতের জন্য বিকল্প নয়। তবে বর্তমানের জন্য একটি বিকল্প এবং আগামী বছরগুলোতেও তা অব্যাহত থাকতে পারে।