ফিরে দেখা
চেরনোবিলে কিসের ভুলে পারমাণবিক চুল্লিতে ইতিহাসের ভয়াবহতম বিস্ফোরণ হয়েছিল
৩৯ বছর আগে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়েছিল বিশ্ব। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি চুল্লিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এতে আশপাশের এলাকায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। এটি পরিত্যক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। আজও অঞ্চলটি মারাত্মকভাবে তেজস্ক্রিয় থেকে গেছে। আজ ২৬ এপ্রিল, শনিবার ভয়াবহ চেরনোবিল বিপর্যয়ের বর্ষপূর্তি। চেরনোবিল বিপর্যয় কেন ঘটেছিল, এর প্রভাব কী, কবে সেখানকার পরিবেশ স্বাভাবিক হবে—তা নিয়ে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজকের এই ফিরে দেখা।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল (২৫ এপ্রিল দিবাগত রাত)। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলে অবস্থিত ভি আই লেনিন নামের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ চুল্লিতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। সেই সময় একদল প্রকৌশলী চুল্লিটিতে একটি পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেন। তবে তা করতে গিয়ে নানা ভুল পদক্ষেপ নেন তাঁরা। এ ঘটনায় পারমাণবিক কেন্দ্রটির ভেতরে হঠাৎ বিদ্যুৎপ্রবাহ বেড়ে চুল্লিটি উত্তপ্ত হয়ে যায়। এরপর একের পর এক বিস্ফোরণ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক চুল্লির মূল অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে লাগা একাধিক আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন। পরে হেলিকপ্টার থেকে বালু ও অন্যান্য পদার্থ ছড়িয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও তেজস্ক্রিয়তার বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আনাটাকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল। তারা শুরুতে এ দুর্ঘটনার কথা গোপন রাখে। বাতাসের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা ইতিমধ্যে সুইডেন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেখানকার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীরা তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি টের পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এর ব্যাখ্যা চায়। প্রথমে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করলেও অবশেষে ২৮ এপ্রিল তারা দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পারমাণবিক শক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৭৭ সালের শুরুর দিকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ইউক্রেন ও বর্তমান বেলারুশ সীমান্তের ঠিক দক্ষিণে চারটি আরবিএমকে ধরনের পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন করেন। প্রিপিয়াত নদীর তীরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান। প্রতিটি চুল্লি ১ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনে সক্ষম ছিল।
প্রকৌশলীদের অদক্ষতা
১৯৮৬ সালের ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় একদল প্রকৌশলী চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪ নম্বর চুল্লিতে একটি বৈদ্যুতিক প্রকৌশলভিত্তিক পরীক্ষা শুরু করেন। চুল্লির টারবাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তার জড়তাজনিত শক্তি ব্যবহার করে জরুরি পানির পাম্পগুলো চালানো সম্ভব কি না, তা দেখতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তবে এই প্রকৌশলীরা পারমাণবিক চুল্লির পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। তাঁদের পরীক্ষণ পরিকল্পনাটি ছিল ভুলে ভরা। পরীক্ষা চালাতে গিয়ে প্রথমেই তাঁরা চুল্লির জরুরি নিরাপত্তাব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এরপর তারা খুব কম বিদ্যুৎপ্রবাহ দিয়ে চুল্লিটি চালাতে থাকেন। এতে চুল্লিটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎপ্রবাহ আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টায় তাঁরা অনেকগুলো কন্ট্রোল রড সরিয়ে ফেলেন।
এতে চুল্লির উৎপাদন ২০০ মেগাওয়াটের বেশি হয়ে ধীরে ধীরে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তবে রাত ১টা ২৩ মিনিটের দিকেও প্রকৌশলীরা পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা টারবাইন জেনারেটর বন্ধ করে দেন। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, টারবাইনের ঘূর্ণনশীল জড়তা দিয়ে চুল্লির পানির পাম্প চালানো যায় কি না, তবে সেই শক্তি যথেষ্ট ছিল না। চুল্লি যথাযথভাবে ঠান্ডা না হওয়ায় ভেতরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় গলন ঠেকাতে অপারেটররা একসঙ্গে প্রায় ২০০টি কন্ট্রোল রড চুল্লির ভেতরে ঢুকিয়ে দেন।
তবে সমস্যা হলো, রডগুলোর নকশায় ত্রুটি ছিল। প্রতিটি রডের ডগায় ছিল গ্রাফাইট টিপ। এতে রডের পাঁচ মিটার দীর্ঘ শোষণকারী অংশ ঢোকার আগেই একসঙ্গে ২০০টি গ্রাফাইট টিপ চুল্লিতে প্রবেশ করে। এ কারণে তাপমাত্রা আরও বেড়ে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে চুল্লির ভারী ইস্পাত ও কংক্রিটের ঢাকনা উড়ে যায়।
স্বাস্থ্যগত প্রভাব
ঘটনার পর দ্রুতই বিশ্ববাসী বুঝতে পারে, তারা একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছেন। চেরনোবিলের চুল্লির মোট ১৯০ মেট্রিক টন ইউরেনিয়ামের প্রায় ৩০ শতাংশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখান থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয় এবং চুল্লির চারপাশে প্রায় ১৯ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ‘এক্সক্লুশন জোন’ বা ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ অঞ্চল’ ঘোষণা করে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে অন্তত ২৮ জন প্রাণ হারান এবং ১০০ জনের বেশি মানুষ আহত হন।
জাতিসংঘের পারমাণবিক বিকিরণের প্রভাববিষয়ক বৈজ্ঞানিক কমিটি (ইউএনএসসিইএআর) বলেছে, বিকিরণের সংস্পর্শে আসার কারণে ছয় হাজারের বেশি শিশু-কিশোর থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ এই সংখ্যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আন্তর্জাতিক গবেষকেরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, উচ্চমাত্রার বিকিরণের সংস্পর্শে আসা প্রায় চার হাজার মানুষ এবং অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় আক্রান্ত আরও প্রায় ৫ হাজার মানুষ ভবিষ্যতে বিকিরণ-সংশ্লিষ্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন।
চুল্লির অবশিষ্টাংশের চারপাশ এখন বিশাল ইস্পাতের কাঠামো দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। তেজস্ক্রিয়তার বিস্তার ঠেকাতে ২০১৬ সালের শেষ দিকে এ ইস্পাতের কাঠামোটি স্থাপন করা হয়।
পরিবেশগত প্রভাব
চেরনোবিল বিপর্যয়ের পরপরই প্রায় ৪ বর্গমাইল এলাকা ‘রেড ফরেস্ট’ বা ‘লাল বন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কারণ, ওই অঞ্চলের অসংখ্য গাছ উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা শোষণ করে লালচে-বাদামি রং ধারণ করে এবং মরে যায়।
বর্তমানে চেরনোবিলের প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকাটিতে একদিকে যেমন ভুতুড়ে নীরবতা, আবার অন্যদিকে জীবনের এক আশ্চর্য উপস্থিতি দেখা যায়। সেখানে অনেক গাছপালা আবার গজিয়ে উঠেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা কিছু বন্য প্রাণীর মধ্যে চোখে ছানি পড়া, উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ঘাটতি থাকার মতো কিছু প্রমাণ পেয়েছেন।
পরিত্যক্ত পারমাণবিক কেন্দ্রের চারপাশে মানুষের কার্যকলাপ না থাকায় লিনক্স থেকে শুরু করে এল্ক পর্যন্ত কিছু বন্য প্রাণীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০১৫ সালে বিজ্ঞানীদের করা এক হিসাব অনুসারে, আশপাশের বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রমগুলোর তুলনায় পরিত্যক্ত এলাকায় নেকড়ের সংখ্যা প্রায় সাত গুণ বেশি। মানুষের উপস্থিতি না থাকার বদৌলতে এমনটা সম্ভব হয়েছে।
চেরনোবিল বিপর্যয়ের প্রভাব শুধু পরিবেশ বা স্বাস্থ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নাম, এর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও ছিল ব্যাপক। এই দুর্ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে এবং বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নতুন গতি আনে। বিপর্যয়ের কারণে আনুমানিক ২৩ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ এবং বেলারুশের প্রায় ২৩ শতাংশ এলাকায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে দেশটির এক-পঞ্চমাংশ কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে।
১৯৯১ সালে বেলারুশ তাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় ২২ শতাংশ ব্যয় করেছিল কেবল এই বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে।
চেরনোবিল কবে নিরাপদ হবে
একসময় চেরনোবিল ছিল এক ব্যস্ত শহর। তবে বর্তমান চেরনোবিল আগের রূপের খোলসমাত্র। একসময় শহরের যেসব ভবন মানুষের কোলাহলে মুখর ছিল, সেগুলো এখন পরিত্যক্ত পড়ে আছে। সেগুলোতে শেওলা জন্মেছে, পোকামাকড় বাসা বেঁধেছে।
তেজস্ক্রিয়তা সত্ত্বেও ২০১১ সালে ইউক্রেন সরকার এক্সক্লুশন জোন বা প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকাটিকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়। তখন থেকে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ মানুষ এই পরিত্যক্ত এলাকাটি দেখতে যেতেন। তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করার পর থেকে সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
টক্সিক জিওগ্রাফি বিশেষজ্ঞ টম ডেভিস ২০২৩ সালে নিউজ উইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার হামলা শুরুর আগে চেরনোবিলে একটি জমজমাট পর্যটনশিল্প ছিল। এক দিনের পাস কিনে নিয়ে পরিত্যক্ত এলাকায় যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করার পর, সবকিছু বদলে যায়।’
তবে পরিত্যক্ত এলাকার গভীরে ঢুকলে কিছু মানবজীবনের চিহ্ন এখনো দেখা যায়। নিউজউইকের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ইউক্রেনের পরিত্যক্ত ওই অঞ্চলে কিছুসংখ্যক বয়স্ক ব্যক্তি থাকেন। ঘটনার পর তাঁদের জোর করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে পরে তাঁরা সেখানে ফিরে যান। বর্তমানে সেখানে ১০০ জনের একটু বেশি মানুষ সেখানে বাস করছেন।
সংবাদমাধ্যমটি আরও বলেছে, পার্শ্ববর্তী বেলারুশ অংশে বসবাসকারীর সংখ্যা হয়তো আরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, কিছু লোক মাঝেমধ্যে ওই পরিত্যক্ত ঘরবাড়িগুলোকে ‘গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান’ হিসেবে ব্যবহার করেন।
এলাকাটি বসবাসের জন্য নিরাপদ হতে কত বছর লাগবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আভাস দিয়েছেন। চেরনোবিল–সংক্রান্ত ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে নিউজউইক বলেছে, অঞ্চলটি বাসযোগ্য হতে প্রায় ২০ হাজার বছর লাগতে পারে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিশেষজ্ঞ এই সময়সীমা কমিয়ে প্রায় তিন হাজার বছর বলছেন। আবার কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, হয়তো কয়েক শতক পরেই এলাকাটি আবার মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, এমএসএন, নিউজউইক, হিস্ট্রি.কম