‘অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক বিশ্বে’ কী বার্তা দিতে যাচ্ছে ন্যাটো সম্মেলন

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরক্ষার বিষয়ে ন্যাটোর মনোভাবে আকস্মিক ‘মৌলিক পরিবর্তন’ এসেছে
ছবি: রয়টার্স

সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক পরিস্থিতিতে এবার শুরু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটোর সম্মেলন। স্পেনের মাদ্রিদে তিন দিনের এ সম্মেলন মঙ্গলবার শুরু হয়। মূল আলোচনা শুরুর প্রাক্কালে সামরিক ব্যয় বাড়াতে সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পশ্চিমা এই জোটের প্রধান। তাঁর ভাষায়, আগামীর বিশ্ব ক্রমেই ‘অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক’ হয়ে উঠছে। খবর আল-জাজিরার।

ন্যাটোপ্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরক্ষার বিষয়ে ন্যাটোর মনোভাবে আকস্মিক ‘মৌলিক পরিবর্তন’ এনেছে। গত মঙ্গলবার থেকে সম্মেলনের মূল আলোচনার প্রস্তুতি শুরু হয়। এতে ঘোষণা দেওয়া হয়, সম্মেলনে নতুন দুই সদস্য ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যোগ দেবে। এর মধ্য দিয়েই পরিবর্তনের বিষয়টি বোঝা যায়।

রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটির নিকটতম প্রতিবেশী ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এতে দীর্ঘদিনের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে আসে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। দেশ দুটি এই সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

আট গুণ বাড়ছে র‍্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স

নতুন সদস্যকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি র‍্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্সের শক্তি বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছে ন্যাটো মিত্ররা। এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় আট গুণ বাড়িয়ে ৪০ হাজার থেকে তিন লাখ করা হচ্ছে। বাহিনীর নতুন সদস্যরা নিজ দেশেই অবস্থান করবেন। তবে রুশ সীমান্তবর্তী ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলে দ্রুত মোতায়েনে তাঁদের প্রস্তুত রাখা হবে। ওই অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের মজুত বাড়ানোরও পরিকল্পনা আছে জোটটির।

ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলেনবার্গ বলেছেন, বুধ ও বৃহস্পতিবার সম্মেলনের মূল বৈঠকে ‘আরও বেশি বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত এই বিশ্বে’ জোটের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, ‘একটি বিপজ্জনক বিশ্বে আত্মরক্ষার সামর্থ্য অর্জনে প্রতিরক্ষা খাতে আমাদের আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।’

সম্মেলনে নেতাদের আলোচনার শীর্ষে থাকছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা। মস্কোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া। এই দুটি কাজেই ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর কাছ থেকে আর আর্থিক প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন।

সামরিক খাতে ন্যাটোর ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ। এই জোটের ৩০ সদস্যের মধ্যে কেবল নয়টি দেশ এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। এই সম্মেলনের আয়োজক স্পেন ন্যাটোর লক্ষ্যমাত্রার কেবল অর্ধেক ব্যয় করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে করমর্দন করছেন ন্যাটোপ্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে মাদ্রিদে তিন দিনের এই শীর্ষ সম্মেলন আগামী বছরগুলোর জন্য জোটের গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাটোর নতুন কৌশলগত ধারণাপত্র—এক ধাপে এক দশকের অগ্রাধিকার ও লক্ষ্য স্থির করা।

আলোচনার একটি বড় বিষয় হবে ন্যাটোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ কতটুকু ইউক্রেনকে সাহায্য করা যায়। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যাতে এই সংঘাতকে রাশিয়া-ন্যাটো সংঘাতের রং দিতে না পারেন, সেই প্রকৃত হুমকির বিষয়ে প্রত্যেকে খুবই সতর্ক আছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাল্টিক অঞ্চল এবং পূর্ব ইউরোপের চারটি দেশে ইতিমধ্যে যোদ্ধা সেনাদলগুলোর শক্তি বাড়ানো হয়েছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর দিকে অগ্রসরমাণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এসব সেনাদলকে ব্রিগেড মানে উন্নীত করা হবে।

চীন বন্ধু না শত্রু

কীভাবে চীনকে মোকাবিলায় করা হবে, সে বিষয়েও নিজেদের মধ্যকার বিভক্তি দূর করার চেষ্টা চালাবে সদস্যদেশগুলো। রাশিয়ার শক্তিশালী মিত্র হিসেবে পরিচিত চীন। ন্যাটোর নতুন কৌশলগত ধারণাপত্রে সাইবার নিরাপত্তা থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে জোটের অবস্থান তুলে ধরা হতে পারে।

চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবও সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে স্থান পাবে। পাশাপাশি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব ও শক্তি এবং ন্যাটোর সঙ্গে সেটাকে কীভাবে সম্পর্কিত করা যায়, সে বিষয়টিও নতুন কৌশলগত ধারণাপত্রে উঠে আসতে পারে।

প্রথমবারের মতো অতিথি হিসেবে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে কিছু ইউরোপীয় সদস্য বেইজিংয়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর অবস্থানের বিষয়ে সতর্ক। তারা চাচ্ছে না, চীনকে ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো হোক।

গত সপ্তাহে ন্যাটো মহাসচিব বলেন, ‘আমরা চীনকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে চাই না।’ তবে তিনি বলেন, ‘বেইজিং আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের স্বার্থ, আমাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।’

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় স্মারকে সই করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: রয়টার্স

সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ব্যাপারে তুরস্ক যা বলল

শুরুতে বিরোধিতা করলেও ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোর সদস্য করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে তুরস্ক (নতুন নাম তুর্কিয়ে)। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের নেতাদের সঙ্গে মঙ্গলবার একটি যৌথ স্মারকে সই করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এতে বলা হয়, নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মোকাবিলায় পূর্ণ সমর্থনের হাত প্রসারিত করা হবে। এক বিবৃতিতে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো বলেন, ‘ত্রিপক্ষীয় এই চুক্তি অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে মাদ্রিদ সম্মেলনে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণে সমর্থন দেবে তুরস্ক।’

এর আগে এরদোয়ান জোর দিয়ে বলেছিলেন, দুই নরডিক দেশ কুর্দি বিদ্রোহীদের বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করলেই কেবল তিনি তাদের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার সুযোগ দেবেন। কুর্দি বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী বিবেচনা করে আঙ্কারা। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় জানিয়েছে, ‘সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে তুরস্ক যা চেয়েছে, তা পেয়েছে।’

আরও পড়ুন

তুরস্কের যোগাযোগ অধিদপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী, দুই নরডিক দেশ পলাতক ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণের বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে তুরস্কের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী প্রপাগান্ডা’ ঠেকানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা এবং সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও ফিনল্যান্ড ও সুইডেন একমত হয়েছে।

‘জেগে ওঠো’

সোমবার মধ্য ইউক্রেনের ক্রেমেনচুক শহরের একটি শপিং মলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় রাশিয়া। এটি চলমান এই যুদ্ধের ভয়াবহতার একটি নির্মম স্মারক। যখন শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭–এর নেতারা জার্মানিতে মিলিত হয়েছেন এবং ন্যাটো সম্মেলনের প্রাক্কালে এ হামলা চালানো হয়। কেউ কেউ হামলার সময় বাছাইকে মস্কোর পক্ষ থেকে সরাসরি বার্তা হিসেবেই দেখছেন।

ন্যাটো সম্মেলনের বুধবার ভার্চ্যুয়ালি ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির। তিনি শপিং মলে হামলাকে ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেন।

কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিতস্কো মাদ্রিদ পৌঁছেছেন। রাশিয়াকে থামাতে ‘যা যা প্রয়োজন’, তা সরবরাহ করতে জোটের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাবেন তিনি। ন্যাটো সম্মেলনের ভেন্যুতে ভিটালি বলেন, ‘জেগে ওঠো। এখন এটা (ইউক্রেনে) ঘটছে। এরপর আপনারা এর শিকার হতে যাচ্ছেন। চোখের পলকে এটা আপনাদের দরজায় কড়া নাড়তে যাচ্ছে।’

এদিকে স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করে সম্মেলনের উদ্বোধনী সামনে এনেছে রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা রসকসমস। মাদ্রিদের সম্মেলনস্থলের পাশাপাশি হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিনের সরকারি দপ্তরের ভৌগোলিক অবস্থান প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

রুশ মহাকাশ সংস্থাটি বলেছে, সম্মেলনে রাশিয়াকে শত্রু ঘোষণা করতে পারে ন্যাটো। সম্মেলনস্থলের নিখুঁত অবস্থান প্রকাশ করে সংস্থাটি বলছে, ‘যদি কাজে লাগে’।

আরও পড়ুন