ইউক্রেন যুদ্ধে কেন মানুষ ম্যার্কেলের দায় দেখেন

জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল
ছবি: এএফপি

ইউক্রেন ২০০৮ সালেই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে পারত। কিন্তু ওই সময় ইউক্রেনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। তাঁর সরকারের দাবি ছিল, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান মানে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তবে এখন অনেকে মনে করেন, ম্যার্কেল ওই বিরোধিতা না করলে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পেত। আর তখন ন্যাটোভুক্ত ইউক্রেনে হামলা চালানোর সাহস করতেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর মেয়াদ শেষ করে চ্যান্সেলর পদ থেকে বিদায় নেন ম্যার্কেল। আর রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। এই যুদ্ধ থামাতে ম্যার্কেলকে সবচেয়ে কার্যকর ব্যক্তি হিসেবে মনে করেন অনেকে। ম্যার্কেলের সঙ্গে পুতিনের কূটনৈতিক রসায়নও দারুণ বলে জানান তাঁরা।

গার্ডিয়ান–এর খবরে বলা হয়, ক্ষমতা ছাড়ার পর প্রথমবারের মতো মঙ্গলবার রাতে জনসমক্ষে আসেন ম্যার্কেল। বার্লিনে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময় তিনি জার্মানির দার স্পিগেল পত্রিকায় এক সাক্ষাত্কার দেন। দীর্ঘ ১৬ বছর দেশ চালানো শেষে সাংবাদিকদের দেওয়া তাঁর প্রথম সাক্ষাত্কার এটি। ২০০৮ সালে জর্জিয়া ও ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেই পরিকল্পনার বিরোধিতা করার কারণে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়া আটকে যায়। ওই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে দাবি করে সাক্ষাৎকারে ম্যার্কেল বলেন, ‘আমরা এখন যে ইউক্রেনকে জানি, তখন দেশটি এমন ছিল না। তখন ইউক্রেন ছিল নানাভাবে বিভক্ত। এমনকি সংস্কারপন্থী শক্তি তিমোশেঙ্কো ও ইউশচেঙ্কোর মধ্যেও মতভেদ ছিল। এর অর্থ দেশটির গণতন্ত্র অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী ছিল না। এ সময় ইউক্রেন শাসন করত ধনকুবেররা।’

নিজের শাসনামলে পুতিনকে তিনি যেভাবে সামলেছিলেন, তার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই বলেও দাবি করেন ম্যার্কেল। তিনি বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগত যদি আমি বলতাম যে পুতিনের সঙ্গে কথা বলার কোনো অর্থ নেই। এটা খুব দুঃখজনক যে আলোচনা (পুতিন-ম্যার্কেল) ঠিকমতো কাজে দেয়নি। কিন্তু তার জন্য আমি নিজেকে দোষ দেব না।’

ম্যার্কেল বলেন, রাশিয়ার পক্ষ থেকে মনে করা হতো ইউক্রেনকে ন্যাটোতে নেওয়া মানে যুদ্ধ ঘোষণা। যদিও পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা শেয়ার না করলেও সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর বলেন, পুতিন কী ভাবছেন, তিনি তা জানতেন। তাই তিনি পুতিনের সেই ভাবনাকে উসকে দিতে চাননি। তিনি ইউক্রেনের সর্বোচ্চ স্বার্থ বিবেচনা করেই ন্যাটো জোটে দেশটির যোগদান আটকে দেন। ম্যার্কেল বলেন, ‘আপনি দু–এক দিনের মধ্যে ন্যাটোর সদস্য হয়ে যেতে পারবেন না। এটা একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আমি জানতে পারি, পুতিন এমন কিছু করবেন, যা ইউক্রেনের জন্য ভালো কিছু হবে না।’

এরপর ২০১৪–১৫ সালের মধ্যে তৎকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্র পোরোশেঙ্কো মিনস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা করেন তিনি। তবে তখন দেশটি সামরিকভাবে পিছিয়ে থাকায় অনেক ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে বলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

ম্যার্কেল ওই চুক্তির সমর্থনে বলেন, তাঁরা ইউক্রেনের জন্য মূলত সময় নিয়েছিলেন। ওই চুক্তির ফলে উত্তেজনা ক্রমে কমে আসে এবং ইউক্রেন নিজেকে গড়ার সুযোগ পায়। এ সুযোগে বর্তমান ইউক্রেন সৃষ্টি হয়েছে।

সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, নতুন ইউক্রেনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলেনস্কি।

সাক্ষাৎকারের শুরুতে ম্যার্কেল তাঁর ক্ষমতা ছাড়ার পরের সপ্তাহ কীভাবে কাটিয়েছেন, তা তুলে ধরেন। বাল্টিক সাগরের কাছে হাঁটাহাঁটি, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের ম্যাকবেথ শুনে সময় কাটানোর কথা বলেন তিনি। এরপর আলোচনা ক্রমে ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ক্রেমলিনের প্রতি জার্মানির নরম মনোভাব পুতিনকে উৎসাহিত করেছিল কি না? ম্যার্কেল বলেন, তাঁর ১৬ বছরের শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সৃষ্ট ভূরাজনৈতিক সমস্যাগুলো অনুভব করেছেন তিনি। স্নায়ুযুদ্ধের সঠিকভাবে অবসান ঘটানো সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার কাছে সব সময় এই প্রশ্ন রয়ে গেছে।

ম্যার্কেল বলেন, ক্ষমতা ছাড়ার শেষ সপ্তাহগুলোয় তিনি রুশ আগ্রাসনের আশঙ্কাকে গুরুত্বসহকারে নিতে শুরু করেছিলেন। ওই সময় বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। ওই সময় তিনি রোমে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সাবেক এই চ্যান্সেলর বলেন, ‘ওই সময় পুতিনের কথায় ইঙ্গিত ছিল। আমরা এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম মিনস্ক চুক্তি আর খাটবে না।’

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা স্পষ্ট ভাষায় করলেও ম্যার্কেল এই যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাদেরও দোষারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যা ঘটেছে, তা রাশিয়ার দিক থেকে বিরাট ভুল। সব আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কোন ভূখণ্ডটি কার, তা নিয়ে যদি আমরা এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দী পর্যন্ত লড়তে থাকি, তাহলে যুদ্ধ চলতেই থাকবে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমি পুতিনের মতাদর্শ ধারণ করি না। কিন্তু আমরা এমন একটি নিরাপত্তা কাঠামো তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছি, যা এই যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারত। আমাদের এটা নিয়েও ভাবতে হবে।’

ম্যার্কেল আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়নি পুতিনকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বদলানো যাবে। তাই রাজনৈতিক সহযোগিতা অসম্ভব হলেও মস্কোর সঙ্গে কিছুটা অর্থনৈতিক সংযোগ রাখা যুক্তিপূর্ণ মনে হয়েছিল।’ ম্যার্কেল স্বীকার করেন, ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সামরিক বাহিনীর পেছনে পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ।