ইউক্রেনের যে শহরে একসঙ্গে অস্ত্র চালানো শিখছেন মা-মেয়ে
প্রায় দুই মাসের হামলায় ইউক্রেনের কয়েকটি শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলেও অনেক জায়গায় কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছে রুশ বাহিনীকে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দেখা গেছে।
অনেক এলাকার নারীরাও শিখছেন অস্ত্র চালানো। ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের তেমনই একটি শহর ইভানো ফ্রাঙ্কিভিস্ক। যেখানে মা-মেয়ে একসঙ্গে শিখছেন কী করে কালাশনিকভ রাইফেল থেকে গুলি ছুড়তে হয়।
ইভানো ফ্রাঙ্কিভিস্কের একটি স্কুলে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কয়েকজন মা ও মেয়ে। সংখ্যায় ১০ জন। স্কুলটির লম্বা-সরু বেজমেন্টে প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীদের বয়স ১৮ থেকে ৫১ বছরের মধ্যে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন শেরহি কোরনেলিয়েভিচ হামচুক। হামচুক ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল। তিনি বলেন, ‘কিয়েভের চারপাশে যা ঘটছে তা বিবেচনায় নিয়ে আমি মনে করি, প্রত্যেকেরই অস্ত্র হাতে নেওয়া উচিত এবং আমাদের দেশকে রক্ষা করা উচিত।’ প্রশিক্ষণ নিতে আসা নারীদের তিনি শেখাচ্ছেন কী করে রাইফেলের ম্যাগাজিনে গুলি ভরতে হয়। বৃদ্ধাঙ্গুলির সাহায্যে একের পর এক বুলেট নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যেতে হয়।
লিতসে ২০ নামের স্কুলটি ইভানো ফ্রাঙ্কিভিস্ক শহরের সবচেয়ে বড় স্কুল। ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করত। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের অন্যান্য স্কুলের মতো এই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে শুরু হয় অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ।
গত মাসের শেষে পশ্চিম ইউক্রেনের অন্যতম বৃহত্তম শহর ইভানো ফ্রাঙ্কিভস্কের মেয়র ঘোষণা করেন, শহরের ইউক্রেনীয় সমতুল্য কম্বাইন্ড ক্যাডেট ফোর্সের ছাত্রদের শুটিং রেঞ্জের কাজে ব্যবহার করা পাঁচটি স্কুল আবার চালু করা হবে। এসব স্কুলে বেসামরিক ব্যক্তিদের অস্ত্র চালানো শেখানো হবে। সবার প্রশিক্ষণের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও প্রাথমিকভাবে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্রে।
মেয়র রুসলান মার্তসিঙ্কিভ বলেন, পুরুষদের প্রশিক্ষণের জন্য আরও জায়গা রয়েছে। কিন্তু এসব জায়গায় নারীদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নারীদের নিজের এবং তাঁদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
গত ৩১ মার্চ লিতসে ২০ স্কুলে প্রথমবারের মতো নারীদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর প্রথম সপ্তাহে ৩ হাজার ৭০০ নারী প্রশিক্ষণের জন্য নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। যাঁদের সঙ্গে ছিলেন ৮০০ বেসামরিক পুরুষও। পরের সপ্তাহে আরও কয়েক হাজার প্রশিক্ষণের জন্য নাম দেন। এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৩০০-এর বেশি নারী অস্ত্র চালনা শেখার জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন। তাঁদেরই একজন ৫১ বছর বয়সী নাতালিয়া আনোশিনা। অস্ত্র চালানো শিখবেন, এটি কখনো বিবেচনা করেননি তিনি। কিন্তু ইউক্রেনের বুচায় নৃশংসতার কথা শোনার পর তাঁর ১৮ বছর বয়সী মেয়ে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। মেয়ের পরামর্শে রাজি হয়ে যান নাতালিয়া। তিনি বলেন, ‘এটি দুঃস্বপ্নের মতো, ভয়ংকর। বুচার নৃশংসতার বিষয়ে যা শুনেছি, সেটি মেনে নিতে আমার সত্যি কষ্ট হয়েছে।’
ধূসর রঙের হুডি, জিনস ও বেগুনি রঙের জুতা পরা নাতালিয়া দেখছেন তাঁর মেয়ে আনিয়া শুটিং রেঞ্জে কনুইয়ের ওপর ভর করে শুয়ে আছেন। সে কাঁধে একটি রাইফেল আটকে রেখে সেটিতে গুলি ভরার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। নাতালিয়া বলেন, ‘এটি আপনাকে সবকিছু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করে। এগুলো এমন জিনিস, যা আপনাকে কিছু অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। এখন এই শুটিং কোর্সের মতো যেকোনো কিছু আপনাকে সাহায্য করতে পারে।’
লিতসে ২০ এবং শহরের আরও চারটি স্কুলে সপ্তাহের প্রতিদিন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব প্রশিক্ষণ দুই ভাগে বিভক্ত—একটি কালাশনিকভ রাইফেলের মূল বিষয় এবং একটি এয়ার রাইফেল দিয়ে শুটিং রেঞ্জে লক্ষ্যভেদের অনুশীলন। প্রশিক্ষণে অবশ্য সবার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় না। হামচুক বলেন, এই প্রশিক্ষণের মূল বিষয় হলো অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা শেখানো; যাতে সময়মতো তাঁরা এটি ব্যবহারে প্রস্তুত থাকেন।
হামচুক আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইভানো ফ্রাঙ্কিভস্কে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে এখানে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হবে। বুচা ও ইরপিনে কী ঘটেছে, তা আমরা দেখেছি। নারীদের প্রস্তুত হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই কাজ, যুদ্ধের প্রস্তুতি।’
পালাক্রমে চেয়ারে থাকা কাপ লক্ষ্য করে গুলি চালানো শেখার সময় নারীরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যুদ্ধের বিষয়ে কথা বলার সময়ই তাঁরা বিষণ্ন হয়ে ওঠেন। ইভানো ফ্রাঙ্কিভস্কের একজন বিক্রয়কর্মী গ্যালিনা।
প্রশিক্ষণের ঘোষণা শোনার পরই নিজের নাম তালিকায় ওঠান। তিনি মনে করেন, কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, তা জানা যুদ্ধের সময় একটি প্রয়োজনীয় দক্ষতা। বুচার ঘটনাগুলো বেদনাদায়ক। অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক।
গ্যালিনা বলেন, ‘ভবিষ্যতে নিজেকে রক্ষা করতে হলে আপনার এই দক্ষতাগুলো থাকতে হবে। আমার এক ছেলে ও স্বামী সেনাবাহিনীতে। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতিতে আমার নিজের জন্য এই প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অস্ত্রের ব্যবহারের প্রয়োজন না হলে আরও ভালো। তবে অন্তত এটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা আমি শিখব। আমরা এ ছাড়া আর কী করতে পারি? এটা এখন জীবনের অংশ।’
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।