ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ: ভুল হলো কোথায়

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই সামলে উঠেছিল ইউরোপীয় দেশগুলো। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুইই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছিল যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো। কিন্তু এখন শীতের আগে আগে অঞ্চলটিতে আবার ভাইরাসটির সংক্রমণ ও কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর হার বাড়ছে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোথায় ভুল হলো, তার অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের (ইসিডিসি) তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ও ইইউভুক্ত দেশগুলোয় দিনে নতুন সংক্রমণ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজারে। শুধু তাই নয়, ৭২ দিন মৃত্যুহার স্থিতিশীল থাকার পর তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষত বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মাল্টা, রোমানিয়া ও স্পেনে মৃত্যুহার বাড়ছে নতুন করে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আবারও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিস্থিতি আবার বাজে দিকে যাওয়ার কারণ হিসেবে বেশ কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। সম্প্রতি গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কাজে যোগ দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা আবার স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে। এতে করে কর্মক্ষেত্র চালু হওয়ায় মানুষের বিচরণ বাড়ছে। আর এসব মিলেই নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষত তরুণদের মধ্যে সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে।

ইউরোপে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলেও এখনো তা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভালো আছে। ইউরোপের ৭৫ কোটি মানুষের মধ্যে ৪৪ লাখ মানুষ এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ১৭ হাজার ২৭৮। অথচ ৩৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছে ৬৭ লাখ মানুষ। আর মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ৯৮ হাজার।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গত শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। এটি এড়ানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা মহামারির বিস্তারের দিকে সতর্ক নজর রাখছি। ইতিমধ্যে ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও এর ধাক্কা লাগবে নিশ্চিতভাবে।’

তবে আরেকবার জাতীয়ভাবে লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নিতে চান না বলে জানিয়েছেন বরিস জনসন। তাঁর মতে, মানুষ স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চললে, এটি মোকাবিলা করা সম্ভব। বিবিসিকে দেওয়া এ সম্পর্কিত এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানককও বলেছেন এ কথা। একই সঙ্গে তিনি স্বাস্থ্যবিধি কার্যকরে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও বলেন।

এদিকে যুক্তরাজ্যের অনেক সাধারণ মানুষই আর লকডাউন দেখতে চান না। গতকাল শনিবার লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে লকডাউন-বিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। একপর্যায়ে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রেপ্তার করা হয় ৩২ জনকে। এটি কোনো ভালো ইঙ্গিত দেয় না।

আজ রোববার যুক্তরাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, ২৮ সেপ্টেম্বরের পর যদি কারও শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, তবে তাঁকে সেলফ-আইসোলেশনে থাকতে হবে। না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১৩ হাজার ডলার জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া গত সপ্তাহেই ইংল্যান্ডে সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে কিছু নতুন বিধি আরোপ করা হয়েছে।

একইভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে মাদ্রিদেও। স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ১১ সেপ্টেম্বর স্পেনে মোট নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয় ১২ হাজার ১৮৩ জন। স্পেনে নতুন করে আক্রান্তদের এক-তৃতীয়াংশই মাদ্রিদের।

উল্লেখ্য, দৃশ্যপটে যুক্তরাষ্ট্র হাজির হওয়ার আগে স্পেনেই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছিল। সংক্রমণের দিক থেকে ইউরোপে এখনো দেশটি শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। দেশটির ৬ লাখ মানুষ এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৩০ হাজার।

ফ্রান্সের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, গত শুক্রবার দেশটিতে নতুন সংক্রমণ ধরা পড়েছে ১৩ হাজার ২১৫ জনের। এপ্রিলের পর এটিই ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সংখ্যা। নতুন এ ধাক্কায় এরই মধ্যে ফ্রান্সের বড় শহরগুলোর বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।

একই দিনে চেক প্রজাতন্ত্রে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ জনের। নেদারল্যান্ডসে শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৭৭ জন। নেদারল্যান্ডসে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে সংক্রমণ হার দ্বিগুণ হয়েছে। এ হারে চলতে থাকলে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে দৈনিক নতুন সংক্রমণ সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় দেশটির ছয়টি অঞ্চলের রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ও বারে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

গত মে মাসের পর এখন আবার ইতালিতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। গত শুক্রবার দেশটিতে ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৯০৭ জন, যা গত মে মাসের পর সর্বোচ্চ। আর গতকাল শনিবার পোল্যান্ডে এক দিনে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১ হাজার ২ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে।

নতুন এই পরিস্থিতিকে খুবই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক হ্যানস ক্লুগ। তিনি বলেন, এখন প্রতি সপ্তাহে শনাক্ত হওয়া নতুন সংক্রমণের সংখ্যা গত মার্চের হিসাবকেও অতিক্রম করছে। ৫০-৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে। তবে এখনো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরা।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে হ্যানস ক্লুগ বলেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে নেওয়া বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করার কারণে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ যেমন কিছুটা ঢিল দিয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যে সুরক্ষা নীতি মেনে না চলার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষত তরুণদের মধ্যে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াটা ভীষণ আশঙ্কাজনক।

বিভিন্ন দেশের জনবহুল শহরগুলোতে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। এর কারণ, এসব শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আবার চালু হয়েছে। লোকজন অফিসে ফিরছে। শিক্ষার্থীরা ফিরছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। স্পেন ও অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে সত্য। এ ছাড়া গ্রিস, ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম ধাক্কা মিলিয়ে যেতে না যেতেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পদক্ষেপ নেওয়াটা একটা বড় ভুল। আরও অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল। বিশেষত পর্যটনকে সীমাবদ্ধ রাখাটা খুব জরুরি ছিল। এ ছাড়া অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন জরুরি ছিল।