ইউরোপের রাজনীতিতে মাতাল হাওয়া

আন্দ্রেই বাবিস, সেবাস্তিয়ান কুর্জ ও ভিক্টর অরবান। ছবি: এএফপি
আন্দ্রেই বাবিস, সেবাস্তিয়ান কুর্জ ও ভিক্টর অরবান। ছবি: এএফপি

কিছুদিন ব্রেক্সিট নিয়ে টালমাটাল ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ ধাক্কার ধকল সয়ে উঠতে না উঠতে কাতালান সংকট। চলছে স্বাধীনতার ঘোষণা, পাল্টা ঘোষণা। ইউরোপে প্রবহমান ঘটনার মধ্যে চলছে নানা উত্থান-পতন। এর মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। 

চেক প্রজাতন্ত্রে সাধারণ নির্বাচনে আন্দ্রেই বাবিস নামের এক ধনকুবের জয়ী হয়েছেন। প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের সম্পদের মালিক তিনি। তাঁর রাজনৈতিক দল এএনও নিজেদের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী বলে দাবি করে থাকে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ায় সেবাস্তিয়ান কুর্জ নামের ৩১ বছর বয়সী এক তরুণ রাজনীতিবিদ ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছেন। তিনি সরকার গঠনে এখন সাবেক নব্য নাৎসিদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য আলোচনা করছেন।

জার্মানিতে অভিবাসনবিরোধীরা স্থানীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দেশটির কেন্দ্রীয় আইনসভা বুন্দেসটাগে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন দখল করে নিয়েছে অভিবাসনবিরোধীরা। উগ্র জাতীয়তাবাদই এদের মূল আদর্শ। আর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান মধ্য ইউরোপকে ‘অভিবাসনমুক্ত এলাকা’ বলে ঘোষণা করেছেন।

এসব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই উগ্র জাতীয়তাবাদ একটি প্রধান অনুষঙ্গ। উল্লিখিত প্রতিটি দেশেই ক্ষমতাসীনেরা দোষ দিচ্ছে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ২০১৫ সালের শরণার্থী নীতিকে। দেখা যাবে, এসব দেশ ইউরোপের হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বায়নের সুফল পুরোপুরি পায়নি। এখন এই দেশগুলোই ইইউর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউরোপে শরণার্থী সংকটের শুরুতে ইইউ ওই অঞ্চলের প্রতিটি দেশের জন্য শরণার্থী গ্রহণের সীমা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়াসহ কিছু দেশ তা মানেনি। এর মধ্য দিয়ে পোলিশ নেতা জারোস্লো কাজিনস্কি বা হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান ইইউর নির্দেশ সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন।

তবে মধ্য ইউরোপের সব দেশের নেতার অবস্থা কিন্তু এমন নয়। অনেকেই ইইউ থেকে লাভের গুড় আদায় করে নেওয়ার পক্ষপাতী। অস্ট্রিয়ার সেবাস্তিয়ান কুর্জ সমন্বিতভাবে ইউরোপীয় সীমান্ত ব্যবস্থাপনার দিকে আগ্রহী। চেক প্রজাতন্ত্রের আন্দ্রেই বাবিস আবার একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক। তিনি জানেন, ইউরোপীয় অঞ্চলের সমন্বিত সরবরাহব্যবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ সীমান্ত চালু থাকলে তাঁর দেশের সাফল্য বেশি হবে। অন্যদিকে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো ইউরো অঞ্চলে নিজের বর্তমান অবস্থান ও প্রভাব নিয়েই খুশি। অর্থাৎ এই দেশগুলো প্রয়োজনমতো যখন খুশি ইইউকে ব্যবহার করছে এবং কেউই একে পুরোপুরি ছাড়তে চায় না।

ইউরোপের এ ধরনের নেতাদের তালিকায় নতুন সংযোজন আন্দ্রেই বাবিস। এই ধনকুবের এর আগে চার বছর চেক প্রজাতন্ত্রের অর্থ মন্ত্রণালয় সামলেছেন। জোট গঠনের হিসাব ঠিক থাকলে এবার পুরো দেশ সামলাবেন। তবে তিনি ইউরো থেকে বেরিয়ে যেতেও যেমন রাজি নন, তেমনি পাকা জাতীয়তাবাদীও নন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চেক কর্মকর্তার মতে, বাবিস আসলে এমন একজন ব্যক্তি, যাঁর আদতে কোনো আদর্শই নেই। বাইরে থেকে দেখলে তিনি অভিজাততন্ত্রবিরোধী একজন ব্যক্তি।

চেক প্রজাতন্ত্রের অর্থনীতি হলো ইউরোপের সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল অর্থনীতি। এটি এখন উদ্বৃত্ত অবস্থায় আছে। অথচ এই দেশের মানুষ একজন ধনী ও রাগী রাজনীতিককে ভোট দিয়েছে, যাঁর দল প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে আগ্রহী। বিবিসির একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাবিস ব্যবসার আদলে দেশ চালাতে চান। তিনি কর বাড়াতে চান। তিনি রাশিয়ার বা ইইউ—কারও পক্ষের লোক নন। বাবিস এই দুই পক্ষের মাঝামাঝি একটি পথে চলেন।

চেক প্রজাতন্ত্রের মতো ইউরোপের দেশগুলোর জন্য ইইউর সদস্যপদ খুব লাভজনক। এর জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ১৯৮৯ সালের ৩০ বছর পরও পাশের দেশ জার্মানির মজুরির তুলনায় চেকের মজুরির হার মাত্র ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির পুরো সুবিধা ইইউর মাধ্যমে পেতে পারে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। কিন্তু ইউরো মুদ্রা চালুর মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা উঠলেই এসব দেশ এ জোটে যোগ দিতে আপত্তি জানাতে শুরু করে। অর্থাৎ তারা শুধু ইইউর সুবিধা চায়, অসুবিধা নয়।

এখন ইউরোপের এসব দেশে দ্রুত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উত্থান হচ্ছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। একদিক থেকে চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলোতে গোষ্ঠী শাসনের উত্থান ঘটছে; রাজনৈতিক আবদারের কাছে নতি স্বীকার করছে আমলাতন্ত্র। রাজনৈতিক নেতাদের সামলে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ। কিন্তু সেখানে তাও নেই।

ভিক্টর অরবান তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছেন তাঁর ফিডেজ পার্টির অনুকূলে। পোল্যান্ডের জারোস্লো কাজিনস্কি প্রধানমন্ত্রী পদে না থেকেও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখছেন। চেক নেতা আন্দ্রেই বাবিসও যে গণতান্ত্রিক কিছু করবেন না, তা বোঝাই যাচ্ছে। এসব ইউরোপীয় নেতা একদিকে যেমন জনসাধারণের মতামতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তেমনি বিরোধীদেরও দমন করেন।

চেক প্রজাতন্ত্রের নিজস্ব ব্যবস্থাতেই ফাটল রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হলে আন্দ্রেই বাবিস নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দেবেন। কারণ, তিনি যে শুধু রাষ্ট্রের আদর্শগত পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন, তা-ই নয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করবেন গোষ্ঠী শাসন। কৃষি ও শিল্প খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি চেক প্রজাতন্ত্রের দ্বিতীয় শীর্ষ এই ধনকুবের দুটি পত্রিকারও মালিক। সুতরাং ভবিষ্যতে দেশটিতে পরিস্থিতি কতটা ভালো থাকবে, তা বলা মুশকিল।

বিষয়টি এমন নয় যে বৈপ্লবিক লোকরঞ্জনবাদের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে গেছে ইউরোপের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল। তবে সাগরে একটি ঘূর্ণি যে সৃষ্টি হয়েছে, তা নিশ্চিত। এখন এটি কী ধরনের ও কতখানি প্রভাব বিস্তার করে, সেটিই দেখার বিষয়।

দ্য ইকোনমিস্ট ও বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে অর্ণব সান্যাল