ইরাক যুদ্ধের ১৯ বছরে কী শিখল পশ্চিমা গণমাধ্যম

বসরায় সাদ্দাম হোসেনের প্রাসাদের বাইরে সেনারা। ছবিটি ২০০৩ সালের এপ্রিলে তোলারয়টার্স ফাইল ছবি

ইরাকে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হামলা শুরু হয়। যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা রবার্ট ইনলাকেশ বলছেন, মার্কিন হামলায় ১০ লাখেরও বেশি ইরাকি নিহত হয়েছে। মিথ্যা অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা চালিয়েছিল—এটা এখন অনেকটাই প্রমাণিত। ইরাকে রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধ থেকে পশ্চিমা গণমাধ্যমের যে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল, তা তারা নেয়নি। ইউক্রেনে চলমান রাশিয়ার হামলার ক্ষেত্রেও পশ্চিমা গণমাধ্যম একই ভুল করে যাচ্ছে।

রবার্ট ইনলাকেশ ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অধিকৃত অঞ্চলে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। সেখানেই তিনি থাকেন। কাজ করেন কুদস নিউজে। তিনি ‘স্টিল অব দ্য সেঞ্চুরি: ট্রাম্পস প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল ক্যাটাসট্রফে’ তথ্যচিত্রের পরিচালক।

আরও পড়ুন

সংবাদ সংস্থা আরটিতে রবার্ট ইনলাকেশের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরাক যুদ্ধের সময় আমেরিকানদের বলা হয়েছিল, বিশ্বশান্তির জন্য ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে সরানো দরকার। সাদ্দামের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র, জঙ্গি দল আল–কায়েদার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সাদ্দাম গণহত্যা চালাতে চান—এমন অভিযোগও ছিল। সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সাদ্দাম হোসেনকে নাৎসি জার্মানির শাসক অ্যাডল্ফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেন। সে সময় নাইন–ইলেভেনের হামলার কারণে পশ্চিমাদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যবিরোধী বিদ্বেষ তুঙ্গে ছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ—এ প্রচার চালিয়ে ইরাকে হামলাকে বৈধ করতে চেয়েছিলেন।

পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে একপেশে সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগ তুলেছেন রবার্ট ইনলাকেশ
ছবি: ফেসবুক

সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতা লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে আনা বড় অভিযোগগুলোর একটিও সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস ইরাক যুদ্ধকে আগ্রাসন ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যম এই হামলাকে কেবল যুদ্ধ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।

সে সময় পশ্চিমা গণমাধ্যম সবকিছুর জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম সম্প্রদায়কে দায়ী করে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের এমন উপস্থাপনের কারণে ইরাক যুদ্ধের আগে মার্কিনদের সমর্থন ছিল ৫২ থেকে ৬৪ শতাংশ। আর হামলার দিনে সমর্থন বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে।

ইরাকে মার্কিন হামলার প্রথম দুই মাসে ৭ হাজার ১৮৬ জনেরও বেশি ইরাকি নিহত হয়েছে। আর সে সময় পশ্চিমা গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিজয়ের খবর প্রকাশ করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের সংবাদ উপস্থাপনের ধরনে মনে হয়েছে, ইরাকে কোনো মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অনুসারে সাদ্দামের কাছে থাকা বিধ্বংসী অস্ত্র কোথায় গেল, সে প্রশ্ন পশ্চিমা কোনো গণমাধ্যমই তোলেনি। এর প্রমাণ হিসেবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সম্পর্কে বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্ড্রু মারের দেওয়া বক্তব্য উল্লেখ করেছেন রবার্ট ইনলাকেশ। রবার্ট বলেন, ‘টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই তাঁরা বাগদাদ দখল করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত ইরাকিরা বিজয় উদ্‌যাপন করবে। আর টনি ব্লেয়ার চূড়ান্তভাবে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে পেরেছেন।’

দূরে গোলাগুলি চলছে। বাড়ি ফিরছেন এক ইরাকি নারী। ছবিটি বসরা থেকে ২০০৩ সালের এপ্রিলে তোলা
রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম দুই দেশের সরকারের সমর্থনে কভারেজ দিতেই থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যুদ্ধাপরাধের উদাহরণ দিতে গিয়ে রবার্ট কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ২০০৩ সালের ২ এপ্রিল বাগদাদে রেড ক্রিসেন্টের মা ও শিশু হাসপাতালে মার্কিন যুদ্ধবিমান হামলা চালায়। গার্ডিয়ানের খবর অনুসারে ওই হামলায় হাসপাতালে অনেককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হামলার প্রায় দুই বছর পরে বলা হয়, ইরাক যুদ্ধে এক লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। তারপরও ২০০৪ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ পুনর্নির্বাচিত হন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকে হামলার অনুমতি দেয়নি। অগণিত বেসামরিক নাগরিক হামলায় নিহত হয়েছে। যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকারীরা বুশ ও ব্লেয়ারের বিচারের দাবি জানিয়েছে।

আরও পড়ুন

এসবকিছুর পরও ২০০৩ সালের ৬ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিন বুশ প্রশাসনের পক্ষেই সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইরাকে হামলার সময় বুশ কী কী ভুল করেছেন, খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা নিয়ে সমালোচনা প্রকাশ করে টাইম ম্যাগাজিন। আর দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘এখন শান্তির জন্য লড়াই’। ওই প্রতিবেদনে ইরাকের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বদলে ইরাক পুনর্বাসনের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। সিএনএন, বিবিসি, ফক্স নিউজ ও অন্য পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো ইরাক যুদ্ধ নিয়ে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পরে দুঃখ প্রকাশ করেছে।পশ্চিমা সাংবাদিকেরা এমনটাও বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা নিয়ে আমাদের আরও সতর্ক থাকা দরকার ছিল।

যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ইউক্রেন ছেড়ে পাশের দেশগুলোর দিকে ছুটছেন লাখ লাখ মানুষ। দেশত্যাগের পথ ধরার জন্য ঘুমন্ত শিশুকে কোলে নিয়ে রেলস্টেশনে বসে আছেন এই মা
এএফপি ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা পিটার ভ্যান বুরেন ইরাকে এক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইরাকে হামলা থেকে পশ্চিমা গণমাধ্যম কী শিক্ষা নিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কী শিক্ষা নিল? কোনো শিক্ষাই নেয়নি। ২০০৩ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি। সে সময় মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যম সরকারের মিথ্যে কথাগুলো কেবল মুদ্রিত করেনি, বরং সেগুলো জোরেশোরে প্রচার করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এমনভাবে খবর প্রচার করেছে, যাতে যুদ্ধকে বৈধ করে তোলা হয়েছে। সে সময় তাদের প্রধান সম্পাদক হয়ে উঠেছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ; যিনি সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন তারা পশ্চিমাদের সঙ্গে, না সন্ত্রাসীদের সঙ্গে? আর গণমাধ্যম তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হামলার পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ভিন্নমতকে দমিয়ে দেয়।’

রবার্ট ইনলাকেশ
ছবি: টুইটার

পিটার ভ্যান বুরেন বলেন, ‘২০২২ সালে পরিস্থিতি সামান্যই বদলেছে। গণমাধ্যম আবারও যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে। আর এবার পশ্চিমা গণমাধ্যম ইউক্রেন সরকারের মিথ্যা প্রচার করছে। ইউক্রেন সরকারের পক্ষ থেকে আসা সব ভিডিও ও ছবি একপেশেভাবে প্রচার করছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। ২০০৩ সালেও একইভাবে ইরাক যুদ্ধের খবর প্রকাশের জন্য উৎস হিসেবে পশ্চিমা সরকারের ওপর নির্ভর করেছিল পশ্চিমা গণমাধ্যম। রাশিয়ার পক্ষের মতগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যম বাতিল করে দিচ্ছে।’
এখন ইরাকে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের অনেকটাই পশ্চিমাদের জানা। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাবেক নেতাদের এ জন্য কোনো পরিণতি ভোগ করতে হয়নি। ইরাকে এখনো মার্কিন সেনা রয়েছে। গত বছরের শুরুতে ন্যাটো ইরাকে আরও চার হাজার সেনা মোতায়েন করার ঘোষণা দিয়েছে।

তবে এসবের পরও ইরাকে জঙ্গি দল আইএসের উত্থান-পতন চলছে। সুন্নি-শিয়া যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের নির্যাতনকেন্দ্র, রাসায়নিক অস্ত্র নতুন প্রজন্মের ইরাকিদের কাছে আতঙ্কের স্মৃতি। নতুন ইরাকি প্রজন্ম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের সম্মুখীন হয়েছে। মূলত, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে এই প্রশাসন তৈরি হয়েছে।

কী শিক্ষা নিল? কোনো শিক্ষাই নেয়নি। ২০০৩ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি। সে সময় মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যম সরকারের মিথ্যে কথাগুলো কেবল মুদ্রিত করেনি, বরং সেগুলো জোরেশোরে প্রচার করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এমনভাবে খবর প্রচার করেছে, যাতে যুদ্ধকে বৈধ করে তোলা হয়েছে। সে সময় তাদের প্রধান সম্পাদক হয়ে উঠেছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ; যিনি সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন তারা পশ্চিমাদের সঙ্গে, না সন্ত্রাসীদের সঙ্গে? আর গণমাধ্যম তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হামলার পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ভিন্নমতকে দমিয়ে দেয়
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা পিটার ভ্যান বুরেন

রবার্ট ইনলাকেশ প্রশ্ন তুলে বলেন, হামলার ১৯ বছর পরেও কি যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করতে পারবে? অবশ্যই না। ওয়াশিংটন এখনো ইরানের ক্ষমতা খর্ব করতে ইরাকে নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে ইরাকে আল–কায়েদা ও অন্য সন্ত্রাসী দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল না। জাতি বা ধর্মীয় বিভেদও ছিল না। ২০০৩ সালের পর থেকে ইরাক বিভক্ত হয়ে গেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষে থাকা গণমাধ্যমগুলো একইভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরাক যুদ্ধের সময় ভুল কভারেজের অভিজ্ঞতাকে রাশিয়ার সময়ও কাজে লাগায়নি পশ্চিমা গণমাধ্যম। ইরাকে হামলাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করা না হলে মার্কিন সরকার কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই নৈতিকতার পক্ষে কথা বলার অধিকার রাখে না। ইরাক যুদ্ধের জন্য বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে বলেই মনে করেন ইনলাকেশ।