করোনার কালেও কিছু আশা

করোনার কালে মনোবল বাড়াতে ইতালির বিভিন্ন ভবনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনেককে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
করোনার কালে মনোবল বাড়াতে ইতালির বিভিন্ন ভবনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনেককে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের ১৭১ দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন সংক্রমণ ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। এমন আতঙ্ককে অনেকে বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে মানুষকে। এর মধ্যে ইতালির ‘বেলা চাও’ গানটি ছড়িয়ে পড়েছে।

এই লোকসংগীত ইতালির ধানখেতের নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদী গান হিসেবে গাওয়া হতো। পরে এটি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়। প্রতিবাদের এই গান মানুষকে এখন সাহস জোগাচ্ছে। খারাপ খবরের মধ্যে আশা খুঁজে পাওয়ার মতো সংবাদ রয়েছে। গৃহবন্দী থাকা মানুষ নতুন নতুন চিত্রকর্ম করছেন, প্রিয়জনকে সময় দিচ্ছেন।

দূষণ কমে গেছে
একের পর এক শহর লকডাউন বা বন্ধ করে দেওয়ায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দূষণ কমে গেছে। চীন ও ইতালিতে কলকারখানা বন্ধ থাকায় বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ কমে গেছে। গাড়ি চলাচল কমে গিয়ে বায়ুদূষণ কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একজন গবেষক বিবিসিকে জানিয়েছেন, গাড়ি চলাচল কম হওয়ায় গত বছরের তুলনায় কার্বন ডাই–মনক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে যেসব গ্যাস, এর মধ্যে কার্বন ডাই–মনক্সাইড অন্যতম। বহু দেশে বিমান চলাচল পুরো বন্ধ হয়ে রাখা হয়েছে, অনেক দেশে সীমিত হয়ে গেছে। এতে বায়ুদূষণ কমবে। মানুষ ঘরে থেকে কাজ করার কারণে অনেক ধরনের দূষণ কমে গেছে।

চীনে গত দুই সপ্তাহে ২৫ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহার কমে গেছে। এতে সারা বছরের দেশটিতে অন্তত এক ভাগ কার্বন নিঃসরণ কমে যাবে। এর আগে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার ৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমে যায়।

ভেনিসের খালগুলো এখন স্বচ্ছ
ইউরোপের অন্যতম পর্যটন শহর ইতালির ভেনিস। আর ভেনিসে এসেছেন, কিন্তু ভেনিসের খাল ভ্রমণ করেননি—এমন পর্যটক পাওয়া কঠিন। গত বছরেও ভেনিস পর্যটক এসেছিল আড়াই কোটি। ২০২৫ সালের মধ্যে এ শহরে ৩ কোটি ৮০ লাখ পর্যটক ঘুরতে আসবেন। প্রতিদিন লাখখানেক পর্যটক নিয়ে ভেনিসের খাল, লেক দাবড়ে বেড়ায় ছোট–বড় ইঞ্জিনচালিত জাহাজ, স্পিডবোটসহ ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো। এর ফলে ভেনিসের খালের পানি ঘোলা, সেখানে মাছ দেখা যায় না। ভেনিসকে রক্ষা করতে স্থানীয় লোকজন আন্দোলন করছেন অনেক দিন ধরে। তবে ভেনিসে পর্যটন বন্ধ করা তো দূরের কথা, সীমিত করা যায়নি। কারণ শুধু ভেনিসের পর্যটক থেকে ২০০ কোটি ইউরো ইতালি আয় করে।

তবে করোনাভাইরাস ইতালিতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভেনিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এতে ফিরতে শুরু করেছে ভেনিসের খালের চেহারা। মাত্র কদিনেই ভেনিসের পানি নীল স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। পানি এতটাই স্বচ্ছ ও নীল যে মাছও দেখা যাচ্ছে। এমন স্বচ্ছ পানি ভেনিসের জনগণ শেষ কবে দেখেন, তা মনে করতে পারছেন না।

মানবিক হৃদয়ের মানুষ বাড়ছে
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পৃথিবীর বহু দেশের শহর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার জন্য মুদি ও সুপারশপগুলোয় হামলে পড়েছে। গণমাধ্যমে এসব খবর ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। তবে ভাইরাসটি বর্তমান দুনিয়াতে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, ঐক্য, মানবিকতার বহু উদাহরণ তৈরি করেছে। করোনাভাইরাসের মহামারির এই সময় ‘মানুষের পাশে মানুষ’ এমন বার্তাও ছড়িয়ে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ১ হাজার ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বয়স্ক ও দরিদ্রদের জন্য ওষুধ ও মুদিসামগ্রী পৌঁছে দেয়।

ফেসবুক বলেছে, যুক্তরাজ্যের কয়েক হাজার মানুষ করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য একটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী দলে যোগ দিয়েছে। একই ধরনের স্বেচ্ছাসেবী দল কানায় তৈরি হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার সুপার মার্কেটগুলো বয়স্কের নিরাপদে ও শান্তিতে কেনাকাটার জন্য বিশেষ সময় ঘোষণা করেছে।

কানাডার ৩৫টি ফেসবুক গ্রুপের ৩০ হাজার সদস্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষ খাদ্য, স্যানিটাইজার, টিস্যু, জরুরি ওষুধসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য বিনা মূল্যে বিতরণ করছেন।

যূথবদ্ধ মানুষ সাহস জোগাচ্ছে
প্রচণ্ড ব্যস্ত জীবন থেকে হুট করে বাসায় গৃহবন্দী হওয়া অনেকের জন্য অসহ্য ও বিরক্তিকর। তবে ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। সারা ইতালি যখন বন্ধ করে দিয়েছে, তখন ইতালির একই ভবনের বিভিন্ন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে। একে অপরের দিকে হাত নেড়ে তারা চিৎকার করছেন।

সারা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে মানুষদের। এ ধরনের দৃশ্য আগে কখনো কল্পনাও করা যেত না। তাঁরা গাইছেন আশাবাদের গান। এর মধ্যে ইতালির ‘বেলা চাও’ গানটি ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ স্পেনের একজন শরীরচর্চাবিদ তাঁর বাসভবনের মাঝখানের খোলা জায়গায় নিয়মিত ব্যায়ামের ক্লাস করাচ্ছেন। সেটি দেখে ওই ভবনের অন্যরা নিজের বাসার ব্যালকনিতে ব্যায়াম করছেন।

ঘরে বসে থাকার এই দিনে অনেকেই তাঁদের বন্ধু, বান্ধবী আপনজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন। অনেকে আবার অনলাইনে দল বেঁধে আড্ডাও দিচ্ছেন।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে যাঁরা বাস্তবে সেবা দিচ্ছেন, সেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে মানুষ বেশি বেশি লিখছেন, তাঁদের মনোবল ধরে রাখতে সাহস জোগাচ্ছেন। ইউরোপের কয়েক হাজার মানুষ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিবাদন জানিয়েছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের।

সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বাড়ছে
কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দী। এ রকম পরিস্থিতিতে মানুষ দিনের পর দিন ঘরে থাকায় তাদের নানান ধরনের নিজের মেধা ও প্রজ্ঞা ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় এর প্রতিফলনও ঘটছে। চিত্রকর্ম, বই পড়াসহ নানা রকম নতুন নতুন সৃজনশীল কাজ গৃহবন্দী থাকা মানুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেনাসিসের একজন আর্টের শিক্ষক অনলাইনে লাইভ ক্লাস নিচ্ছেন। যেসব শিশু স্কুলে না যেতে পেরে ঘরে বসে আছে, তারা এ ক্লাস থেকে কিছু শেখার সুযোগ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির পাবলিক লাইব্রেরি ভার্চ্যুয়ালি লাইব্রেরি পরিদর্শন ও বই পড়ার ব্যবস্থা করেছে।

ইতালির অনেকে অনলাইনে মজাদার রান্না করার ক্লাস নিচ্ছেন। যাতে ঘরে বসেই নানা পদের রান্না করা যায়। ইতালির কাচের জানালা ও দরজায় নানা রকম চিত্রকর্ম করছেন দেশটির শিশুরা। সেখানে তারা আশাবাদের কথা লিখছে। তারা বলছে, ‘আমরা গৃহবন্দী, কিন্তু আশাবাদের বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে।’

বিবিসি ও গার্ডিয়ান অবলম্বনে