কিয়েভ দখলে রুশ সেনাদের আটকে দিয়ে ‘নায়ক’ যে নদী

ইরপিন নদীর পানি দিয়ে এভাবে জলাশয় তৈরি করে ইউক্রেন বাহিনী।ছবি : সংগৃহীত

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছিল শক্তিশালী রুশ বাহিনী। কিন্তু দখল করতে পারেনি কিয়েভ শহর। ইউক্রেনের জনগণ ও সেনাদের সাহসিকতার পাশাপাশি এই প্রতিরোধযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছে ইরপিন নামে একটি নদী। কিয়েভের পক্ষ থেকে এই নদীকে তাই ‘নায়ক’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযানের নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রুশ বাহিনী কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। কিয়েভ দখল করা যখন কিছু সময়ের ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছিল, তখনই যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসেবে ইরপিন নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ খুলে দেন ইউক্রেনের সেনারা।

যুদ্ধ শুরুর আগে ওই বিশাল এলাকা ঘিরে নতুন আবাসিক স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা ছিল কিয়েভের। কিন্তু যুদ্ধের কারণে জলাভূমিটি আগের অবস্থা ফিরে পেয়েছে।

তাঁদের ধারণা ছিল, এই নদীই হয়তো রুশ সেনাদের সামনে এগোতে দেবে না। তাঁদের শহর রক্ষা করবে। ইউক্রেনের সেনাদের এই কৌশল কাজে লাগে।

ইরপিন নদীটি রাজধানী কিয়েভ থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে। রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে ইরপিন নদীর পানি দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে ইউক্রেন সেনাবাহিনী। ওই এলাকা একসময় জলাভূমি ছিল। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় বিশাল প্রতিরোধের এক দেয়াল। অবশ্য ইউক্রেনীয় সেনাদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছিলেন রুশ সেনারা। ইরপিন নদীর বাঁধে ইউক্রেনীয় সেনাদের কার্যক্রম ঠেকাতে সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর ঘটনাও ঘটে।

ইরপিন নদীটি যেভাবে শহরটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। কিয়েভকে রক্ষায় এই নদীর অতীত ইতিহাসও রয়েছে। ১৯৪১ সালে ইউক্রেনীয়রা জার্মানদের বিরুদ্ধে কিয়েভকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবে একে ব্যবহার করেছিল।

একটি ভাঙা সেতু দিয়ে লোকজন ইরপিন ছেড়ে পালাচ্ছেন।
ছবি : রয়টার্স

সেই ইতিহাস মেনেই আবার ইরপিনকে রক্ষাকবচ বানিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। নদীর পানি ১৩ হাজার হেক্টর জলাভূমি তৈরি করে। কিয়েভের দিকে ধেয়ে আসা রুশ সেনাদের সাঁজোয়া যানের বিশাল বহর ওই বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে আটকে যায়। এর আগে ১৯৬০–এর দশকে সোভিয়েত সেনারা ওই জলাভূমির পানি সেচে ফেলেছিলেন।

কিয়েভের প্রাচীন এই জলাভূমির ফিরে আসাটা আশীর্বাদ হয়েও উঠতে পারে। এই ইরপিন নদী আজ না থাকলে কিয়েভ যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হতে পারত।
অ্যালেক্সি ভ্যাসিলিউক, জীববিজ্ঞানী ও ইউক্রেনের প্রকৃতি সংরক্ষণ গ্রুপের (ইউএনসিজি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান

যুদ্ধ শুরুর আগে ওই বিশাল এলাকা ঘিরে নতুন আবাসিক স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা ছিল কিয়েভের। কিন্তু যুদ্ধের কারণে জলাভূমিটি আগের অবস্থা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু জলাভূমিটি এখন ওই এলাকার স্থানীয় লোকজন ও প্রকৃতি–পরিবেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন এক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

স্থানীয় পরিবেশবিদ ভলোদিমির বোরেকো ইরপিন নদীকে ‘নায়ক নদী’ উপাধি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি, এ নদীকে নায়কের মর্যাদা দিয়ে এর পরিবেশগত সুরক্ষা শক্তিশালী করতে হবে। কারণ, এ বছর ইরপিন ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী ও আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে মিলে আমাদের রাজধানী রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ভূমিকা হাজার বছরের মধ্যে অনন্য।’

বোরেকো আরও বলেন, নদী অববাহিকায় সরকার যে বিশাল নির্মাণযজ্ঞের পরিকল্পনা করেছিল, তা অবশ্যই বাতিল করতে হবে। এই ইরপিন নদী কেবল এবারের যুদ্ধেই কিয়েভকে রক্ষা করেনি, বরং এ নদী না থাকলে ভবিষ্যতে আক্রমণের মুখে কিয়েভের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে।

কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে দেখা ইরপিন নদী
ছবি : এএফপি

পরিবেশবিদ বোরেকোর ভাষ্য, হাজার বছর আগে কিয়েভান রুশের দিনগুলোতে ইরপিন নদী বারবার কিয়েভকে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে পোলোভৎসিয়ান ও পেচেনেগদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিল। ১৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর প্লাবনভূমি এত প্রশস্ত ও জলাবদ্ধ ছিল যে শত্রু অশ্বারোহী বাহিনী তা অতিক্রম করতে পারত না। পুতিন যদি এক বা দুই বছর পর আক্রমণ করতেন, তাহলে ইরপিন নদীটি রাজধানীকে রক্ষা করতে পারত না। কারণ, এর পুরো প্লাবনভূমি ঘিরে গড়ে উঠত বসতি। জলাভূমি যেত হারিয়ে। শত্রুর ট্যাংক সহজেই শহরময় দাপিয়ে বেড়াত।

ইউক্রেনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির কর্মকর্তা বোহদান প্রোটস বলেন, সোভিয়েত দখলের আগে ইরপিনের প্লাবনভূমি ছিল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। একে ইউক্রেনের আমাজন বলা হতো। এটি কোথাও কোথাও পাঁচ মিটার গভীর ছিল। এখানে বিশালাকার ক্যাটফিশ ও স্টার্জন মাছ ছিল। এ ছাড়া এখন বিলুপ্ত সাদা লেজযুক্ত ইগলের মতো জলাভূমির পাখি ও নানা শিকারি পাখিতে পূর্ণ ছিল জলাভূমিটি।

বোহদান প্রোটসের মতে, ইরপিনে সোভিয়েতের তৈরি বাঁধ এ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। পুরোনো প্লাবনভূমিতে অনেক উন্নয়নকাজ শুরু হয়।

ইরপিন নদীর ওপর একটি সেতু ভেঙে রুশ সেনাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।
ছবি : এএফপি

এতে একসময়ের সমৃদ্ধ জলাভূমির ওপর আরও চাপ পড়ে। তবে এখন আবার পানি ফিরে আসায় শিগগির সেখানে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য দেখার আশা করা বৃথা। কারণ, বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া পরিবেশগত উন্নয়নের জন্য আরও সময় লাগবে। এ ছাড়া দুশ্চিন্তার নাম হতে পারে মশা। এই জলাভূমি ব্যাপক মশা তৈরি করতে পারে।

আরও পড়ুন

এখন প্রশ্ন উঠছে, যুদ্ধ থামলে এই জলাভূমি থাকবে কি না। জীববিজ্ঞানী ও ইউক্রেনের প্রকৃতি সংরক্ষণ গ্রুপের (ইউএনসিজি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অ্যালেক্সি ভ্যাসিলিউক বলেন, ‘তিনি আশা করছেন ইরপিনের এই জলাভূমি থাকবে। বিশেষ করে রাশিয়া যতক্ষণ না পর্যন্ত কিয়েভ দখলের আশা পরিত্যাগ করছে, তত দিন এটি শহরটির প্রতিরক্ষায় থেকে যাবে। কিন্তু আবার একে সেচে ফেলা হবে কি না, তার গ্রহণযোগ্যতা দেখতে পাচ্ছি না। এ ছাড়া যা ঘটে গেছে, তা আবার বদলে ফেলা অসম্ভব ও অত্যন্ত কঠিন। এখন এটি মাছ ও বিভিন্ন পাখির আবাস হয়ে উঠতে পারে।’

জলাভূমি অঞ্চলটির খারাপ পরিস্থিতির বিষয়ে ভ্যাসিলিউক বলেন, এখন এর তলায় অনেক রাশিয়ার ট্যাংক ও সামরিক সরঞ্জাম রয়ে গেছে। রাসায়নিক ও তেলের মিশ্রণ ও দূষণ এখানে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে বিপদ থাকলেও কিয়েভের প্রাচীন এই জলাভূমির ফিরে আসাটা আশীর্বাদ হয়েও উঠতে পারে। এই ইরপিন নদী আজ না থাকলে কিয়েভ যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হতে পারত বলেও উল্লেখ করেন এই জীববিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন