ড্রোনে বদলে যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি

‘সুইচব্লেড-৩০০’
ছবি: সংগৃহীত

স্নেক আইল্যান্ডের বাতিঘরে লুকানো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাটারিতে একের পর এক গুলি চলছে। আইল্যান্ডটি ইউক্রেনের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত। ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাটারিতে গুলি ও তার পরের অবস্থার পুরো দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়েছিল তুরস্কের নকশা করা বেরাকতার টিবি২ মডেলের ড্রোন থেকে।
গার্ডিয়ান জানায়, টিবি২ একটি দূরনিয়ন্ত্রিত ‘কিলার ড্রোন’। ১৯০ মাইল দূরে নিশানা করে আঘাত হানতে সক্ষম এটি। রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাটারিতে গুলির ঘটনার আগে ওই ড্রোন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একরকম উধাও হয়ে যায়।

কারণ, তুরস্ক থেকে কেনা দুই ডজন বা তারও বেশি এই ড্রোনের সব কটি রুশ বাহিনী ভূপাতিত করেছে মনে করা হচ্ছিল। রাশিয়া নাখোশ হতে পারে—এ যুক্তিতে ইউক্রেনকে নতুন ড্রোন দিতে চায়নি আঙ্কারা। তবে যেভাবেই হোক, ইউক্রেনের হাতে যে তুরস্কের ড্রোন ঠিকই পৌঁছেছে, তার প্রমাণ স্নেক আইল্যান্ডের ঘটনা। ওই ঘটনার এক দিন পরেই আরেকটি টিবি২ ড্রোনের ভিডিও প্রকাশ পায়। যেখানে একটি যুদ্ধযান ধ্বংসের ভিডিও দেখা যায়। এর এক দিন পরে রাশিয়ার সেনাদের অবতরণের সময় একটি এমআই–৮ হেলিকপ্টার ধ্বংস হতে দেখা যায়।

উড্ডয়ন বিশেষজ্ঞ অ্যামেলিয়া স্মিথ এসব ভিডিও চিত্রে টি ২৫৩—একটি নতুন রেজিস্ট্রেশনের ড্রোন শনাক্ত করেন। এই মডেলের ড্রোন আগে ইউক্রেনে দেখা যায়নি। গত মাসেই এই মডেল তুরস্কে পরীক্ষা করা হয়। এটা থেকে ধারণা করা যায়, ভিডিওর ড্রোনগুলো নতুন সরবরাহ করা হয়েছে।

এক সপ্তাহের মধ্যে রুশ বাহিনী জানায়, তারা ৯টি টিবি২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে। যেগুলোর প্রতিটির মূল্য ১০ থেকে ২০ লাখ ডলারের মধ্যে। টিবি২ সামরিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম এবং এটাকেই সব প্রচারণাকে শক্ত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কিন্তু ড্রোন অবশ্যই সামরিক ব্যবধান গড়ে দেবে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সেটা ভালো করেই জানেন। গত এপ্রিলে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘বেরাকতারের (ড্রোন) এবং অন্য সব সরঞ্জামের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, এটা একটা অন্য যুদ্ধ।’

এর অর্থ এই নয় যে ড্রোন অপ্রাসঙ্গিক। ইউক্রেনের হাতে থাকা ড্রোনের সমতুল্য হলো রাশিয়ার ওরিয়ন ড্রোন। এই ড্রোন অবশ্য যুদ্ধে ব্যাপকভাবে দেখা যায়নি, এই ড্রোন ধ্বংস হলে সেটার বদলি পাওয়াও সহজ নয়।

বেলগোরোদে তেলের গুদামে হামলার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেন স্থানীয় গভর্নর
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল অ্যানালাইসিস থিঙ্কট্যাংকের ড্রোন বিশেষজ্ঞ স্যাম বেনডেট বলেন, ইউক্রেনের পুরো আকাশসীমা যেহেতু রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেই, এ সুবিধা ইউক্রেন বাহিনী ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে।

২০২০ সালে নাগর্নো-কারাবাখে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে রাশিয়া ভালো করেই জানে, তাদের টিবি২ ড্রোন মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, সেই যুদ্ধে আজারবাইজান রাশিয়ার নকশায় তৈরি আর্মেনিয়ার ট্যাংক ধ্বংস করতে তুরস্কের ড্রোন ব্যবহার করে, যা তাদের ভালোই সুবিধা করে দিয়েছিল।
ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মহাকাশ বিশেষজ্ঞ ডগলাস ব্যারি বলেন, মস্কো অনেক দিন ড্রোন প্রযুক্তিতে পিছিয়ে ছিল। এই বিশেষজ্ঞ আরও মনে করেন, ১৯৯০ দশকের প্রথম দিক থেকেই রাশিয়া এই দিক উপেক্ষা করে এসেছে।

গত মার্চে ইউক্রেন যুদ্ধে ওরিয়ন ড্রোন ব্যবহার শুরু করে মস্কো। কিন্তু ড্রোনগুলো কাজ শুরুর পরই ভূপাতিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বেনডেট বলেন, ‘রুশরা ড্রোনের ঘাটতি নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল, তাদের হাতে সম্ভবত দুই বা তিন ডজন ছিল।’

যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যতই বাড়ছে ও আকাশে ড্রোন ধ্বংস হচ্ছে, নতুন ড্রোন সামনে আসছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে আরও অন্তত ৭০০ ড্রোন সরবরাহ করতে রাজি হয়েছে। এসব ড্রোনের মধ্যে কম সংবেদনশীল, একবার ব্যবহারযোগ্য কামিকাজে ড্রোন, সুইচব্লেড ৩০০ ও ৬০০ ড্রোন, এগুলোর মাত্রা ৬ থেকে ২৫ মাইল পর্যন্ত। ড্রোনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চালাতে পারে। ইউক্রেনের এক ভিডিও থেকে দেখা যাচ্ছে, সুইচব্লেডগুলো এর মধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখভাগে পৌঁছেছে।

পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রোন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার লি বলেন, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে কেউ আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করছে না। এ যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষই হালকা, বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য ড্রোন ব্যবহার করেছে। হরহামেশাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। এ যুদ্ধে দুই পক্ষই নিয়মিত গোলাবর্ষণসহ অন্যান্য আক্রমণের ড্রোন চিত্র প্রকাশ করেছে।

ইউক্রেনের রাস্তায় পড়ে আছে রাশিয়ার ট্যাংক
ছবি: এএফপি

যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহারে দুই পক্ষের মরিয়া মনোভাব সত্ত্বেও অধ্যাপক লি মনে করেন, ড্রোন যুদ্ধ জয় করার কোনো প্রযুক্তি নয়। তবে তিনি এ–ও মনে করেন, চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন প্রতিপক্ষের চেয়ে ড্রোন ব্যবহারে দ্রুত এবং শ্রেয়তর তৎপরতা দেখিয়েছে।